লালসালু উপন্যাসের অনুধাবন প্রশ্ন (৫০+ প্রশ্নোত্তর)

লালসালু উপন্যাসের অনুধাবন প্রশ্ন

লালসালু উপন্যাসের অনুধাবন প্রশ্ন: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’। রচনাটিকে একজন প্রতিভাবান লেখকের দুঃসাহসী প্রচেষ্টার সার্থক ফসল বলে বিবেচনা করা হয়। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির ও চঞ্চল।

ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, আবার নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে তোলার উদ্দীপনা ইত্যাদি নানা রকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আবর্তে মধ্যবিত্তের জীবন তখন বিচিত্রমুখী জটিলতায় বিপর্যস্ত ও উজ্জীবিত। নবীন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, এই চেনা জগৎকে বাদ দিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাসের জন্য গ্রামীণ পটভূমি ও সমাজ-পরিবেশ বেছে নিলেন।

আমাদের দেশ ও সমাজ মূলত গ্রামপ্রধান। এদেশের বেশির ভাগ লোকই গ্রামে বাস করে। এই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন দীর্ঘকাল ধরে অতিবাহিত হচ্ছে নানা অপরিবর্তনশীল তথাকথিত অনাধুনিক বৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে।

এই সমাজ থেকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বেছে নিলেন তাঁর উপন্যাসের পটভূমি, বিষয় এবং চরিত্র। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি গ্রামীণ সমাজ; বিষয় সামাজিক রীতি-নীতি, ও প্রচলিত ধারণা বিশ্বাস; চরিত্রসমূহ একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু, শোষিত, দরিদ্র গ্রামবাসী, অন্যদিকে শঠ, প্রতারক, ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক-ভূস্বামী।

‘লালসালু’ একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। এর বিষয় : যুগ-যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব। গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণাজাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণে সমৃদ্ধ ‘লালসালু’ উপন্যাস।

কাহিনিটি ছোট, সাধারণ ও সামান্য; কিন্তু এর গ্রন্থনা ও বিন্যাস অত্যন্ত মজবুত। লেখক সাধারণ একটি ঘটনাকে অসামান্য নৈপুণ্যে বিশ্লেষণী আলো ফেলে তাৎপর্য-মণ্ডিত করে তুলেছেন।


লালসালু উপন্যাসের অনুধাবন প্রশ্ন 

প্রশ্ন-১. ‘মনে হয় এটা খোদাতা’লার বিশেষ দেশ।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: শস্যহীন অঞ্চলের জনজীবনে অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও ধর্মীয় কাজে কার্পণ্য না থাকায় লেখক ব্যঙ্গ করে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন। নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের জীবনে অভাব থাকলেও দেখা যায় ভোরবেলায় মক্তবে কচিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে আমসিপারা পড়ার কোলাহল। পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই, ন্যাংটা, ক্ষুধাতুর ছেলেরা সেই কোলাহলের অংশীদার। তারা জীবনকে যতটা ভালোবাসে মৃত্যুকে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ভয় পায়। তাই লেখক কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বলেছেন, এটি হয়তো খোদাতা’লার বিশেষ একটি অঞ্চল, যেখানে মানুষ এতটা ধৰ্ম সংলগ্ন।

প্রশ্ন-২. মজিদ যে খেলা খেলতে যাচ্ছে তা সাংঘাতিক কেন?
উত্তর: পাছে তার ভণ্ডামি ধরা পড়ে যায়— এই ভয় ও সন্দেহের জন্যে মজিদ তার খেলাকে সাংঘাতিক বলেছে। মজিদ ঠিকই জানে প্রাণধর্মের জাঁতাকলে পিষ্ট হবে একদিন তার প্রথা- ধর্ম। সকল বাধা পেরিয়ে একদিন সত্য বেরিয়ে আসবে। সে বোঝে যেদিন মানুষ সজাগ হবে সেদিন তার মিথ্যা ফাঁদ- ভণ্ডামির দিন শেষ হবে; জয় হবে মানবতার সুনিশ্চিত। তাই সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত, মূর্খ গ্রামবাসীদের নিয়ে সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যে খেলায় নেমেছে, তা বড়ই সাংঘাতিক।

প্রশ্ন-৩. ‘কিন্তু তারও যে বাঁচবার অধিকার আছে সেই কথাটাই সে সাময়িক চিন্তার মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: আলোচ্য উক্তিটি দ্বারা মজিদের নিজস্ব ভাবনার একটি দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে। মজিদ সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার জন্যে মধুপুর ছেড়ে নতুন আশায় মহব্বতনগর গ্রামে এসেছে। তার মূল সিদ্ধান্ত হলো টিকে থাকা ও সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যা করা প্রয়োজন, তাই তাকে করতে হবে। ন্যায়-অন্যায়, সুনীতি-দুর্নীতি হলো মানুষেরই সৃষ্টি, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে তারও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই সে মিথ্যা প্রতারণার কথা জেনেও এই কঠিন দুঃসাহসী কাজে নেমে পড়ে।

প্রশ্ন-৪. ‘মাটি-এ গোস্বা করে’— কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: মাটিতে রহিমা শব্দ করে হাঁটার ফলশ্রুতিতে মজিদ এ উক্তিটি করে। মাটিতে তৈরি দেহ একদিন মাটিতে মিশে যাবে। মাটিকে আঘাত করে হাঁটলে মৃত্যুর পর মাটি বদলা নেবে— এমন ধর্মীয় বিশ্বাস এখনো গ্রামবাংলায় প্রচলিত। মজিদের প্রথমা স্ত্রী রহিমা মাটিতে আওয়াজ করে হাঁটলে তা মজিদের পছন্দ হয় না। তাই মজিদ স্ত্রীকে ধর্মের মোড়কে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যে শাসন করেছে। মজিদ চায় রহিমার মনে যেমন স্বামীর ভয় থাকবে, অনুরূপ চলনেও।

প্রশ্ন-৫. মজিদ রহিমার প্রতি গুরুগম্ভীর হয়ে পড়ে কেন?
উত্তর: রহিমাকে মজিদ তার ও মাজারের প্রতি ভয় সঞ্চার ও ধর্মের মোড়কে জড়ানো নিজের কথার মর্ম বোঝানোর জন্যে গম্ভীর হয়ে পড়ে। মজিদ মহব্বতনগরে স্থায়ী আসন পাতার পাশাপাশি রহিমা নামের এক যৌবনপ্রাপ্ত তরুণীকে বিয়ে করে। কিন্তু সাদাসিধে রহিমার চালচলন একটু বেসামাল। হাঁটার সময় মাটিতে শব্দ করে হাঁটে, যা মজিদের পছন্দ নয়। তাই মজিদ তার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে রহিমার প্রতি গুরুগম্ভীর হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন-৬. ‘কুৎসা রটনা বড় গর্হিত কাজ’- কেন?
উত্তর: কুৎসায় মানুষের মান-মর্যাদার হানি ঘটে বলে তা বড় গর্হিত কাজ। অনেক সময় মানুষ শয়তানের ফাঁদে পড়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে আপন মানুষেরও কুৎসা রটনা করে। কিন্তু সে বোঝে না ভালো মানুষ কখনো কুৎসা রটনা করে না; কুৎসা বড় খারাপ কাজ। হাসুনির মায়ের মা স্বামীর বিরুদ্ধে যে কুৎসিত বক্তব্য দিয়েছে তা চরম কুৎসা। কুৎসা রটনাকারী সর্বত্র ঘৃণিত এবং মানুষের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায়।

প্রশ্ন ৭. ‘সে ঝংকার মানুষের প্রাণে লাগে, কানে লাগে।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসের এই তাৎপর্যপূর্ণ উক্তিটি মজিদের কোরআনের আয়াত পড়ার ঝংকারের প্রতি ইঙ্গিত করেছে। তাহের-কাদেরের বাপের সালিশের দিন সুচতুর মজিদ কোরআনের আয়াত পড়ে তা ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে উপস্থিত উৎসুক জনতার মনে ধর্মের ভয় জাগানোর চেষ্টা করে এবং সফলতা লাভ করে। মজিদের সুরেলা গলার ঝংকার ঘরময় যেন ঝংকৃত হচ্ছিল এবং সে ঝংকার উপস্থিত জনতার কানে বাজছিল এবং প্রাণকে স্পর্শ করছিল। অর্থাৎ, মজিদের কোরআন পড়ার সুমধুর সুরে তারা মোহিত হয়ে পড়েছিল।

প্রশ্ন-৮. যে জিনিস বোঝার নয়, তার জন্যে কৌতূহল প্রকাশ করা অর্থহীন কেন?
উত্তর: আল্লাহর মহিমা ও মর্ম বোঝা সকলের পক্ষে সম্ভব নয় বলে তার জন্যে অহেতুক কৌতূহল প্রকাশ করা অর্থহীন। মজিদ মহব্বতনগরের লোকজনকে শিক্ষা দিয়েছে যে, জন্ম-মৃত্যু, রোগ- শোক সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। সৃষ্টির মর্ম সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন। তবে এটি বুঝতে হবে যে, আল্লাহ যা কিছু করেন তা মানুষের ভালোর জন্যেই করেন। সেজন্যে আল্লাহর কাজকর্মের ব্যাপারে বান্দার এত কৌতূহল না হওয়াই ভালো। বস্তুত এটি মানুষকে দমিয়ে রাখার অপকৌশল।

প্রশ্ন-৯. আল্লাহর ওপর এত ভরসা সত্ত্বেও মজিদের চোখে জ্বালাময়ী ছবি ভেসে ওঠে কেন?
উত্তর: মজিদের ভেতরে পশুবৃত্তির কারণেই তার চোখে জ্বালাময়ী ছবি ভেসে ওঠে। সে যতই মুখে আল্লাহ, রসুল, দ্বীনের কথা বলুক, তার ভেতরে রয়েছে পশুবৃত্তি। তাই তো তার ঘরে যৌবনব্যাপ্ত সুঠাম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সে কাজের মেয়ে হাসুনির মার জন্যে আকুলি-বিকুলি করে, কামনার আগুনে পোড়ে। গ্রামবাসীর সাথে আল্লাহ, রসুলের (স.) কথা বলতে গিয়েও চোখে তার ভেসে ওঠে ভোররাতে দেখা হাসুনির মার জ্বালাময়ী ছবি, উন্মুক্ত গলা, কাঁধ ও বাহুর উজ্জ্বলতা।

প্রশ্ন-১০. মজিদের মন থম থম করে কেন?
উত্তর: মজিদের মন থম থম করে এজন্যে যে, আওয়ালপুরের পির সাহেবের আগমনে সে সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে। স্বা মজিদ ওপরে যা-ই বলুক, ভেতরে ভেতরে সে তার নিজের শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন। পির সাহেবের মতো তার রুহানি শক্তি নেই, আওয়ালপুরে পিরের আগমনে লোকজন তার মাজারে কম আসে। সবাই নতুন পিরকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে, তার পায়ে একটু চুমু দিতে চায়। এসব দৃশ্য দেখে মজিদ গম্ভীর হয়ে যায় এবং মাজারের রুজিরোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রমে তার মনটা থম থম করে।

প্রশ্ন-১১. মজিদের ক্রোধ হয় কেন?
উত্তর: আওয়ালপুরে নতুন পিরের আগমনে তার মাজার ব্যবসার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গ্রামবাসীর ওপর মজিদের ক্রোধ হয়। রাতে শোয়ার সময় মজিদের স্ত্রী রহিমা পির সাহেবের অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। এতে মজিদ বোঝে ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়েছে। তা ছাড়া পরদিন মজিদ দেখে তার এলাকার লোকজনও পিরের কাছে ছুটে চলেছে। এতে মজিদের মনে গাঁয়ের লোকজনের প্রতি ভীষণ ক্রোধ হয়। মূলত আওয়ালপুরের নতুন পিরের আগমনে মজিদের ভিত নড়ে ওঠে।

প্রশ্ন-১২. ‘এ বিচিত্র বিশাল দুনিয়ায় কী যাবার জায়গার কোনো অভাব আছে?’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: গাঁয়ের লোকজনের প্রতি ক্রুদ্ধ মজিদের মনোভাবের পরিচয় আলোচ্য বাক্যটিতে প্রকাশ পেয়েছে। আওয়ালপুরে নতুন পিরের আগমনে দলে দলে লোক ওই পিরের কাছে যাওয়ায় মজিদের মাজারে লোকজন আসা কমে যায়। এতে মজিদ চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং গ্রামবাসীর এ ধরনের কাজ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতরাই শামিল মনে করে। তাই ক্রুদ্ধ হয়ে মজিদ বলেছে, এখানে যদি তার ভালোভাবে থাকবার উপায় না থাকে, তাহলে অন্যত্র সে তার ভবিষ্যৎ দেখবে। বাক্যটিতে মুখোশের আড়ালে মজিদের প্রকৃত চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে।

প্রশ্ন-১৩. মজিদ আওয়ালপুরে গেল কেন?
উত্তর: আওয়ালপুরের পির সাহেবের প্রসার ঘটলে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে— একথা ভেবে মজিদ আওয়ালপুরে গেল। মজিদ অত্যন্ত চতুর এবং কূটকৌশলী একজন মানুষ। সে বুঝতে পেরেছিল মহব্বতনগরের লোকদের ফিরিয়ে আনতে না পারলে তার ধর্ম ব্যবসায় মন্দা পড়বে। সবচেেয় বড় কথা, একবার তার প্রতি কারো অবিশ্বাস বা সন্দেহ দেখা দিলে তা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে, নিজের অবস্থান অটুট রাখার জন্যে, নতুন পিরের কারসাজি সরিয়ে দেওয়ার জন্যে সে আওয়ালপুরে যায়

প্রশ্ন-১৪. পির সাহেব হামলা করতে চায়নি কেন?
উত্তর: আওয়ালপুরের পির আওয়ালপুরে স্থায়ী নয়। তা ছাড়া তার বয়স হয়েছে তাই সে মহব্বতনগরে হামলা করতে চায়নি I আওয়ালপুর থেকে মহব্বতনগর অনেকটা দূর, প্রায় তিন গ্রাম ব্যবধান। এত দূরে এসে হামলা করা তেমন সুবিধার হবে বলে পির সাহেব মনে করেনি। তা ছাড়া বয়সের কারণে এখন সে জরাক্রান্ত ও দুর্বল, যৌবনের তেজ নেই। এই বয়সে দাঙ্গা-হাঙ্গামা তার পছন্দের নয় বলে মহব্বতনগরে সে হামলা করতে উৎসাহ দেখায়নি।

প্রশ্ন-১৫. আমেনা বিবি আওয়ালপুরের পিরের সাহায্য চায় কেন?
উত্তর: আমেনা বিবি সন্তান কামনার জন্যে আওয়ালপুরের পিরের সাহায্য চায়। খালেক ব্যাপারীর প্রথমা স্ত্রী আমেনা বিবি পিরের অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী। ব্যাপারীর সাথে বহুদিন ঘর করেছে সে, কিন্তু তার কোনো সন্তান হয় না। তার বিশ্বাস, পির সাহেবের পানিপড়া খেলে সে সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হবে। আর তাই আমেনা বিবি মাতৃত্বের সাধ পূর্ণ করার জন্যে আওয়ালপুরের পিরের সাহায্য চায়।

প্রশ্ন-১৬. ধলা মিয়া আওয়ালপুরে যেতে চায় না কেন?
উত্তর: আওয়ালপুর ও মহব্বতনগরের মাঝপথে দেবংশি তেঁতুলগাছটির ভয় এবং পিরের সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে ধলা মিয়া আওয়ালপুরে যেতে চায় না। খালেক ব্যাপারী তার সম্বন্ধী ধলা মিয়াকে আমেনা বিবির জন্যে আওয়ালপুর থেকে গোপনে পির সাহেবের পানিপড়া আনতে বলে। ধলা মিয়া ভাবে পানিপড়া আনতে হলে শেষ রাতে যাত্রা শুরু করে ভোর হওয়ার পূর্বেই ফিরে আসতে হবে। পথের মাঝে তেঁতুলগাছের ভূতপ্রেতের আস্তানা এবং পির সাহেবের সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে ধলা মিয়া আওয়ালপুরে যেতে চায় না।

প্রশ্ন-১৭. ‘সে অন্দরের লোক, আর তার তাগিদটা বাঁচা-মরার মতো জোরালো।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসে এ লাইনটিতে আমেনা বিবির জন্যে পানিপড়া আনার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। আমেনা বিবির বিবাহের দীর্ঘ ত্রিশ বছর পরও তার সন্তান হয় না। সে মাতৃহৃদয় পূর্ণ করার জন্যে পিরের সাহায্য চায়। পিরের পানিপড়া খেলে তার ইহজীবনের দুঃখ ঘুচে যাবে, সে সন্তানবতী হবে; পাবে মাতৃত্বের স্বাদ। তাই মজিদের নতুন পিরের কাছে মহব্বতনগরের লোকজনকে যেতে নিষেধ করা ও তার সাথে দাঙ্গা বাধানো আমেনা বিবি মোটেও পছন্দ করেনি।

প্রশ্ন-১৮. হাসুনির মার মন বেদনায় নীল হয়ে ওঠে কেন?
উত্তর: মায়ের মৃত্যুর পর মজিদের কাছে কবরের আজাবের কথা শুনে হাসুনির মার মন বেদনায় নীল হয়ে ওঠে। অশিক্ষিত ধর্মভীরু হাসুনির মার মায়ের বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যু হলে তেমন একটা শোক লাগে না তার। কিন্তু যখন সে মজিদের কথায় বোঝে যে, তার মায়ের কবরে আজাব হবে তখনই তার মনে হাহাকার জাগে। কবরে মায়ের একাকী যন্ত্রণাভোগে তার মনের মধ্যে বেদনা জেগে ওঠে।

প্রশ্ন-১৯. ‘বার্ধক্যের শেষ স্তরে কারো মৃত্যু ঘটলে দুঃখটা তেমন জোরালোভাবে বুকে লাগে না।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: উদ্ধৃত অংশটুকু দ্বারা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভিত্তিতে শিশু-কিশোর বা যৌবন বয়সের মৃত্যু আর বার্ধক্যের মৃত্যুর মধ্যে শোকের তারতম্য তুলে ধরা হয়েছে। অল্প বয়সে কারো মৃত্যু ঘটলে নিকটজনরা খুব বেশি শোক করে। কেননা তার মরার বয়স হয়নি বা সে আরও বহুদিন বেঁচে থাকতে পারত। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে কারো মৃত্যু হলে নিকটজনরা অধিক শোকাহত হয় না, কারণ তারা ধরে নেয় প্রকৃতির নিয়মে স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। তাই হাসুনির মাও তার বুড়ি মায়ের মৃত্যুকে সেভাবে নিয়েছে।

প্রশ্ন-২০. আমেনা বিবির মনে আশার সঞ্চার হলো কেন?
উত্তর: মজিদ যখন মাজার প্রদক্ষিণের কথা বলে তখন আমেনা বিবির ভয় হলেও সন্তানপ্রাপ্তির আশায় তার মনে আশার সঞ্চার হয়। সরল প্রকৃতির মানুষ আমেনা বিবি সন্তান কামনায় অধীর। প্রথমে এসে আওয়ালপুরের পির সাহেবের পানিপড়া না পেয়ে নিরাশ হয়েছিল। সে ধরেই নিয়েছিল তার আর সন্তান হবে না। কিন্তু মজিদ যখন পেটের বেড়ির কথা বলল এবং সাতের বেশি বেড়ি না থাকলে তা খোলার ব্যবস্থার কথা জানাল, তখন তার মনে আশার আলো দেখা দিল।

প্রশ্ন-২১. ‘দুই তানিতে যে প্রচুর তফাৎ আছে সে কথা কী করে বোঝায়?’— কথাটি বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ ও খালেক ব্যাপারী দুজনই ক্ষমতাধর মানুষ হলেও দুজনের ক্ষমতা দুই ধরনের, সে বিষয়টি এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুই তানির মধ্যে একজন মজিদ, অন্যজন খালেক ব্যাপারী। রহিমার পেটে চৌদ্দ বেড়ি আছে মজিদ তা কী করে জানে এ হলো খালেক ব্যাপারীর স্ত্রী তানু বিবির জিজ্ঞাসা। রহিমার কাছে যখন জানল যে তার স্বামী তা বুঝতে পেরেছে তখন তানু বিবির প্রশ্ন হলো- খালেক ব্যাপারী আমেনা বিবির স্বামী হওয়া সত্ত্বেও কেন তার বেড়ির কথা জানে না। তানু বিবিকে বুঝতে হবে, মজিদ খোদার পথের মানুষ। সে খালেক ব্যাপারীর মতো সাধারণ মানুষ নয়। তাই মজিদের ক্ষমতা মাজার থেকে আসে বলে দুজনের মধ্যে পার্থক্যও যথেষ্ট।

প্রশ্ন-২২. এক ঢিলের পথ হলেও ব্যাপারীর বউ হেঁটে যেতে পারে না কেন?
উত্তর: সারাদিন রোজা রেখে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তির জন্যে এক ঢিলের পথ তবুও ব্যাপারীর বউ হেঁটে যেতে পারে না। মজিদের নির্দেশ অনুযায়ী, সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যাবেলায় নুন আর আদা খেয়ে মাগরিবের নামাজের পর আমেনা বিবি মাজারে আসে। পালকি থেকে নামার পর মাজারের দূরত্ব এক ঢিলের পথ হলেও সারাদিন অভুক্ত থাকায় শরীর-মন ক্লান্ত ও অবসরের কারণে মাজারে যাওয়ার বাকি পথ আমেনা বিবি হেঁটে যেতে পারে না।

প্রশ্ন-২৩. মজিদের কাম বাসনাকে সাপের দংশনের সঙ্গে কেন তুলনা করা হয়েছে?
উত্তর: কাম বাসনা মানুষের মনের বিবেচনা শক্তি নষ্ট করে এবং জ্বালা- যন্ত্রণা সৃষ্টি করে বলে মজিদের কামভাবকে সাপের দংশনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পালকি থেকে নেমে যাওয়ার সময় আমেনা বিবির সুন্দর ফর্সা পা দেখে ভণ্ড পির, পরনারীতে আসক্ত মজিদের ভেতর কামভাব জেগে ওঠে। সাপে কামড়ালে সাপের বিষে যেমন মানুষের শরীরে জ্বালা-যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়, তেমনি কামভাব জাগলে মানুষের দেহে ও মনেও যন্ত্রণা হয়। সেজন্য ধর্মের লেবাস পরা ভণ্ড মজিদের কামভাবকে সাপের বিষের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

প্রশ্ন-২৪. ‘সে মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য এবং সে মুখে দুনিয়ার ছায়া নেই।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসে এ লাইনটিতে পালকি থেকে মাজারে যাওয়ার পর আমেনা বিবির ভয়ার্ত চেহারার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিনা আহারে রোজা রেখে, সারাদিন কোরআন পাঠ করে এবং আদা-নুন দিয়ে ইফতার করা আমেনা বিবির শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, অজানা আশঙ্কা যে, মাজার প্রদক্ষিণের পরও যদি সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়। একদিকে অভুক্ত দুর্বল শরীর আরেক দিকে ভয়-শঙ্কা- সবমিলিয়ে আমেনার চেহারা রক্তশূন্য ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। সে মুখ যেন কোনো জীবন্ত মানুষের নয়, সে মুখে পৃথিবীর কোনো লক্ষণ নেই।

প্রশ্ন-২৫. মজিদ এত নিষ্ঠুর কেন?
উত্তর: যে ধর্মের লেবাসে মজিদ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার মানসে মহব্বতনগরে এসেছে, সেই লক্ষ্য অর্জনে ধীরে ধীরে ভণ্ড মজিদ নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে। চালাক মজিদ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মহব্বতনগর গ্রামে আসে। তার প্রতিষ্ঠার মূলে যে তাকে অবজ্ঞা করেছে বা উপেক্ষা করেছে, তাকে সে সরাবেই। যে তার বিরুদ্ধে গেছে, তাকে সে শাস্তি দেবেই। কারণ সে জানে কোমলতা দেখালে সে মহব্বতনগরে টিকে থাকতে পারবে না। তাই না খেতে পাওয়া তৃণমূল থেকে সমাজ চালকের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে মজিদ ক্রমান্বয়ে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন-২৬. ‘খোদার কালামের সাহায্যে যে কথা জানা যায় তা মূর্খের রোজগারের মতো সাফ।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসে ভণ্ড, প্রতারক মজিদ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে যে খোদার কালাম নিয়ে মিথ্যাচার করেছে, তা বাক্যটিতে ফুটে উঠেছে। সুচতুর মজিদ তার প্রতিষ্ঠার পথে বিন্দুমাত্র যাকে বাধা মনে করেছে তাকে সমূলে উৎপাটিত করেছে। আমেনা বিবি আওয়ালপুরের পির সাহেবের পানিপড়া খেতে চেয়ে তাকে যে অপমান ও অবহেলা করেছে, তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে ব্যাপারীর মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে। মজিদ ব্যাপারীকে বলে খোদার কালামের মাধ্যমে প্রাপ্ত কথাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা চলে না। এ কথা সূর্যের আলোর চেয়েও পরিষ্কার। সহজ কথায় সে ব্যাপারীকে বুঝিয়ে দেয়, আমেনার মনে পাপ আছে, তাকে নিয়ে ঘর-সংসার করা যথার্থ হবে না।

প্রশ্ন-২৭. খালেক ব্যাপারী মজিদের কথা ঠিক মনে করল কেন?
উত্তর: খালেক ব্যাপারী ধর্মভীরু বলেই মজিদের কথা ঠিক মনে করল। খালেক ব্যাপারী বিশ্বাস করে, মজিদ কোরআন-কেতাব পড়া আলেম মানুষ বলে আমেনা বিবি সম্পর্কে যা জেনেছে, তা খোদার কালাম পড়েই জেনেছে। সেজন্যে আমেনা বিবিকে তার অপবিত্রতার কারণে তালাক দিতে বলেছে। তার ধারণা, আমেনা বাইরের দিক থেকে নির্দোষ এবং তার আচার-ব্যবহারে আপত্তিকর কিছু না থাকলেও ভেতরে নিশ্চয় গলদ আছে, তা না হলে মজিদ তালাকের কথা বলত না।

প্রশ্ন-২৮. ‘ওটা ছিল নিশানা, আনন্দ আর সুখের’। ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসের এ লাইনটি দ্বারা স্বামীর বাড়ি যে আমেনা বিবির জন্যে সুখের স্থান ছিল, তা ব্যক্ত হয়েছে। মেয়েরা স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনলেই আনন্দে বুকটা ভরে ওঠে। কিন্তু স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা হয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় তার চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে, নেই কোনো ‘আনন্দ’। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির একটা নিশানা ছিল তার আনন্দ আর সুখের, তা হলো থোতামুখো তালগাছ যার জন্যে তার বুক কান্নায় ভাসত। বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি আসার পথে পালকির মধ্যে থেকে তালগাছটি দেখলেই বুঝত সে স্বামীর বাড়িতে এসে গেছে।

প্রশ্ন-২৯. মজিদের মন অন্ধকার হয়ে আসে কেন?
উত্তর: মাজারের রক্ষক ও পির মজিদ এক রাতে মোমবাতির উজ্জ্বল আলোয় মাজারের গিলাফের ঝালরের একটি অংশ বিবর্ণ দেখে তার মন অন্ধকার হয়ে আসে। মজিদ বোঝে মাজারের রহস্য যত দিন থাকবে, তার ক্ষমতাও থাকবে তত দিন। তাই মাজারের প্রতি তার টান প্রচণ্ড বলে মাজারের সামান্য ক্ষতি হলে তার মন খারাপ হয়। সে চায় মাজারটি সব সময় ঝকঝকে থাকুক। এ কারণেই মোমবাতির আলোয় মাজারের গিলাফের ঝালরের একটি অংশ বিবর্ণ এবং এক জায়গাতে সুতো খসে গেলে তার মন অন্ধকার হয়ে আসে।

প্রশ্ন-৩০. রহিমা মজিদের সামনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেন?
উত্তর: দয়ালু খোদা এত কঠিন কেন, এই ভেবে আমেনার জন্যে রহিমা মজিদের সামনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মজিদ খোদার কালামের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য জেনে আমেনাকে শাস্তি দিয়েছে। এ বিষয়টি রহিমার কাছে অস্পষ্ট। তাই আমেনার তালাকের দিন রহিমার মনটা সারাদিন খারাপ থাকে। তার প্রশ্ন একটাই— তা হলো, আমেনা তো অন্যায় কিছু করেছে বলে মনে হয় না। আবার মজিদ যখন বলেছে তা অবিশ্বাসও করা যায় না। ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে যায় রহিমা এবং আমেনার জন্যে তার খারাপ লাগে।

প্রশ্ন-৩১. আক্কাস মিয়া গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায় কেন?
উত্তর: সমাজের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে আক্কাস গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। গ্রামে মক্তব থাকা সত্ত্বেও স্কুলে না পড়লে মুসলমান ছেলের উন্নতি হবে না এবং আধুনিক চিন্তা থেকে বঞ্চিত হবে, এ ধারণা থেকেই আক্কাস গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে মনে করে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে সমাজের মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কারের রাহু দূর হলে মানুষ তার নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে শিখবে। এসব কারণে আক্কাস মিয়া মনে করে গ্রামে একটি স্কুল থাকা উচিত।

প্রশ্ন-৪২. ‘শত্রুর আভাস পাওয়া হরিণের চোখের মতোই সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখ।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসের এ লাইনটিতে মজিদ যখন জমিলার রূপের প্রতি ইঙ্গিত করে এবং জীবনের শেষ পরিণতি মৃত্যুর ভয় দেখায়, তখনকার জমিলার অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। রাতে মজিদ ঘুমন্ত জমিলাকে আচমকা একটানে ওঠানোর ফলে জমিলা ব্যথা পায় এবং ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়ে। পরদিন সকালে জমিলা সব কিছু উপেক্ষা করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করতে দেখে মজিদ আরও ক্ষিপ্ত হয় এবং জমিলার রূপের কথা তুলে নিজের দর্শন শোনায় মৃত্যুর সাথে সাথে রূপের সমাপ্তি, জীবন অল্প দিনের। একথা শুনে জমিলা মজিদের দিকে ক্ষিপ্রগতিতে এমনভাবে তাকায় যেন শত্রুর আভাস পাওয়া হরিণের চোখে যেমন সতর্কতা, তার চোখেও তেমনি সতর্কতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন-৪৩. ‘লতার মতো মেয়েটি যেন এ সংসারে ফাটল ধরিয়ে দিতে এসেছে।’ বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: প্রশ্নোল্লেখিত এ বাক্যে প্রাণ-ধর্মমুখর কিশোরী জমিলার আগমন ধর্ম ব্যবসায়ী মজিদের সংসারে শুধু উৎপাতই নয়, এক জীবন্ত প্রতিবাদ- তাই ব্যক্ত হয়েছে। নেশার বশে মজিদ জমিলাকে বিয়ের পর প্রথম দিকে জমিলাকে বিড়াল ছানার মতো মনে হলেও অল্প দিনের মধ্যেই তার আসল রূপ বেরিয়ে আসে। সে মজিদের কোনো বাধা মানে না, মজিদের সামনে চুপ থাকলেও তাকে পছন্দ করে না। সহজ কথায় অনেক দিনের গড়া সংসারের নিয়মনীতিতে ভাঙন ধরায় সে। একপর্যায়ে মজিদ জমিলাকে ভয় পেতে থাকে। আর এজন্যে সে নিজের ভাগ্যকে দায়ী করলেও তার ভেতরের ক্ষোভে পুড়িয়ে দিতে চায় মজিদের সাজানো সংসারকে।

প্রশ্ন-৪৪. ‘বালু তীরে যুগ যুগ আঘাত পাওয়া শক্ত কঠিন পাথর তো সে নয়।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসের এ বাক্যটিতে জিকিরের সময় জমিলার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। মাজারে সন্ধ্যায় জিকিরের সময় রহিমা খিচুড়ি রান্না করে আর জমিলা রহিমার রান্নাবান্নার কাজ দেখে। বাইরে থেকে যখন বহুমানুষের সম্মিলিত জিকিরের আওয়াজ জমিলার কানে আসে তখন সে ভয়ে সচকিত হয়ে ওঠে। কারণ জমিলা কখনো জিকির শোনেনি। ঝড়ের সময় সমুদ্রের এক একটা ঢেউ যেমন তীরে আঘাত হানে, ঠিক তেমনি জিকিরের ঘন ঘন ধ্বনি জমিলার হৃদয়ে আঘাত হানে। জমিলার হৃদয় সমুদ্রের তীরের মতো শক্ত নয়।

প্রশ্ন-৪৫. ‘তার আনুগত্য ধ্রুবতারার মতো অনড়, তার বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল।’ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোল্লেখিত এ বাক্যটি দ্বারা মজিদের প্রথমা স্ত্রী রহিমার স্বামীভক্তির এক চমৎকার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মজিদের প্রথমা স্ত্রী রহিমা মজিদের ঘরে আসার পর থেকেই মজিদের খুব অনুগত। শান্তশিষ্ট কর্ম-নিপুণা এই মেয়েটি যেন সমস্ত শ্রম, ভালোবাসা আর সেবা দিয়ে খুঁটির মতো মজিদের সংসারকে আগলে রেখেছে। কিন্তু মজিদ পরে জমিলাকে বিয়ে করার পর জমিলার অবাধ্যতার কারণে মজিদ ভীত-শঙ্কিত। তাই জমিলা ও রহিমার মাঝে তুলনা করে বলেছে, রহিমাকে আমার খুব আপন মনে হয়, কারণ তার ওপর সব কিছুতে নির্ভর করা যায়।

প্রশ্ন-৪৬. মজিদ জমিলাকে হ্যাঁচকা টান মেরে বসিয়ে দেয় কেন?
উত্তর: মজিদ জমিলাকে খোদাভীতির আড়ালে নিজের প্রতি অনুগত করতে সংসার সম্বন্ধে অজ্ঞ জমিলাকে হ্যাঁচকা টান মেরে বসিয়ে দেয়। রাত গভীর হলে মজিদ দেখে জমিলা জায়নামাজে সেজদা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এতে মজিদের ধারণা হয় জমিলার মনে খোদার ভয় নেই, থাকলে এভাবে সে ঘুমাত না। ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে মজিদ জমিলাকে এক হ্যাঁচকা টানে জায়নামাজ থেকে উঠিয়ে বসায়।

প্রশ্ন-৪৭. জমিলা বেঁকে বসে কেন?
উত্তর: জমিলা কিশোরী হলেও যখন বুঝতে পারে মজিদ তাকে মাজারে নিয়ে যাচ্ছে, তখন সে বেঁকে বসে। জমিলা প্রথমে বোঝেনি যে তাকে মাজারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে যখন বুঝল তখন সে বেঁকে বসে, এর কারণ মাজার সম্পর্কে তার ভীতি। প্রথমত, সে মাজারের ত্রিসীমানায় কখনো ঘেঁষেনি, দ্বিতীয়ত, মজিদ আজ যে গল্প বলেছে তাতে ভয় আরও বেড়ে গেছে। সেজন্যে সে মজিদের শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চায়।

প্রশ্ন-৪৮. ‘নাফরমানি করিও না। খোদার ওপর তোয়াক্কল রাখো। বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: ভণ্ড, প্রতারক ও ধর্ম ব্যবসায়ী মজিদ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে আলোচ্য অংশটুকু বলেছে। মহব্বতনগরে প্রচণ্ড ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে মজিদকে দেখে গ্রামবাসী হাহাকার করে ওঠে। মজিদ এ অবস্থায় তাদেরকে আশ্বাস দেয়— আল্লাহই মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, খাদ্যের জোগান দেন। সেজন্যে মানুষের উচিত আল্লাহকে স্মরণ করা। আসলে মজিদ বিশ্বাসের কথা বলে মানুষকে উদ্দীপ্ত ও ধর্মভাবাপন্ন করে রাখতে চায়।

প্রশ্ন-৪৯. না ঘুমিয়ে মজিদ দাওয়ার ওপর বসে থাকে কেন?
উত্তর: জমিলাকে মাজারে একাকী বেঁধে রাখার পর মজিদের ধারণা, জমিলা ভয়ে চিৎকার করবে, তাই মজিদ না ঘুমিয়ে দাওয়ার ওপর বসে থাকে। মজিদ জমিলার ওপর নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্যে নানা কৌশল অবলম্বন করে এবং শেষ পর্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকার রাতে মাজারে জমিলাকে বেঁধে রেখে আসে। মজিদের ধারণা, জমিলা ভয় পেয়ে চিৎকার করবে। তাই ঘরের মধ্যে না গিয়ে সে দাওয়ায় বসে থাকে। কিন্তু মজিদের এ কৌশলও ব্যর্থ হয়।

প্রশ্ন-৫০. রহিমা মজিদের কথায় কোনো সাড়া দেয় না কেন?
উত্তর: রহিমা জমিলার বিপদে মজিদের কথায় কোনো সাড়া দেয় না। মজিদের প্রথমা স্ত্রী রহিমা মজিদকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। কিন্তু মজিদ যখন জমিলাকে ঝড়বৃষ্টির রাতে একাকী মাজারে বেঁধে রেখে আসে তখন তার একমাত্র চিন্তা জমিলা মাজারে কেমন আছে। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত স্বামীভক্ত রহিমা স্বামীকে বলেই বসে, ‘ধান দিয়া কী হইব মানুষের জান যদি না থাকে। তাই জমিলার এই বিপদে রহিমার ভেতরটা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

প্রশ্ন-৫১. ‘প্রকৃতির লীলা চেয়ে চেয়ে দেখাও এক রকম এবাদত।’ – বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসের এ বাক্যটিতে মজিদের প্রকৃতির বৈচিত্র্য দেখে সৃষ্টিকর্তার মহিমা উপলব্ধির কথা বলা হয়েছে। যে রাতে মজিদ জমিলাকে মাজারে বেঁধে রেখে আসে, সেই রাতে মাজার ঘরে ছিল ভৌতিক পরিবেশ, আর বাইরের প্রকৃতিতে আসন্ন বিপদের অবস্থা। মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের ঝলকানি, ঝড়, বৃষ্টি— সব মিলিয়ে এক ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগে মজিদের ধারণা ছিল সে জমিলার আর্তনাদ শুনবে। মজিদ চেয়ে চেয়ে বাইরের প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ দেখে এবং ব্যাখ্যা দেয়, প্রকৃতিকে যারা এভাবে দেখে, তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর এবাদত করে।


আশাকরি আমাদের আজকের আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তক, গল্পের বই সহ যে কোন পিডিএফ ডাউনলোড করতে আমাদের সাথেই থাকুন। আমাদের যে কোন আপডেট মিস করতে না চাইলে ফেসবুক ও ইউটিউবে সাবক্রাইব করে আমাদেস দাথে কানেক্ট থাকতে পারেন। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।


আশাকরি আমাদের আজকের আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তক, গল্পের বই সহ যে কোন পিডিএফ ডাউনলোড করতে আমাদের সাথেই থাকুন। আমাদের যে কোন আপডেট মিস করতে না চাইলে ফেসবুক ও ইউটিউবে সাবক্রাইব করে আমাদেস দাথে কানেক্ট থাকতে পারেন। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।

About মেরাজুল ইসলাম

আমি মেরাজুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পাশাপাশি একজন ব্লগার। এডুকেশন এর প্রতি ভালোবাসাও অনলাইল শিক্ষার পরিসর বাড়ানোর জন্য এডুকেশন ব্লগের পথচলা। ব্লগিং এর পাশাপাশি আমি ওয়েবসাইট ডিজাইন, কন্টেন্ট রাইটিং, কাস্টমাইজ সহ ওয়েব রিলেটেড সকল কাজ করি।

View all posts by মেরাজুল ইসলাম →