মুহাম্মদ ঘুরির অভিযানের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা

মুহাম্মদ ঘুরির অভিযানের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা

Political and Social Conditions of India at the Eve of the Expeditions of Muhammad Ghuri

মুহাম্মদ ঘুরির অভিযানের সময় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রাজনৈতিক অনৈক্য, সামাজিক অসাম্য দেশটিকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। এ বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযােগ নিয়ে মুহাম্মদ ঘুরি ভারতে অভিযান চালান এবং সফল হন।

রাজনৈতিক অবস্থা (Political Conditions)

মুহাম্মদ ঘুরির আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজমান ছিল। সমগ্র ভারতে বেশকিছু ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এর মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারতে তিনটি মুসলিম ও বেশ কয়েকটি রাজপুত রাজ্যের উপস্থিতি দেখা যায়। তখন শতদ্র নদী থেকে শােন নদী পর্যন্ত উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ভারতের সমগ্র অঞ্চল রাজপুতদের অধীনে ছিল। সে সময় ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতায় ছিল আজমির ও সম্ভরের চৌহান, মালবের পরমার, চেঁদির কালাচুর, বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলা, গুজরাটের চালুক্য, কনৌজের গহরওয়াল, মগধের পাল ও বাংলার সেন বংশ। তখনকার ছােট ছােট রাজ্যগুলাের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিচে তুলে ধরা হলাে:

মুহাম্মদ ঘুরির অভিযানের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা

পাঞ্জাব: মুহাম্মদ ঘুরির আক্রমণকালে পাঞ্জাব গজনি বংশে শাসক খসরু মালিকের শাসনাধীনে ছিল। সেলজুক তুর্কিদের হাতে গজনির পতনের পর খসরু মালিক পাঞ্জাবে আশ্রয় নেন এবং লাহােরকে রাজধানী করেন। ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও অকর্মণ্য খসরু মালিককে পরাজিত করে মুহাম্মদ ঘুরি পাঞ্জাব জয় করেন।

মুলতান: মুলতান ছিল শিয়া কারামতিয়া মুসলিমদের শাসনাধীনে। সুলতান মাহমুদ সুলতান জয় করেন। তবে তার মৃত্যুর পর কারামতিয়ারা পুনরায় স্বাধীনতা ঘােষণা করে।

সিন্দু: তখন সুমার নামক একটি স্থানীয় রাজবংশ সিন্ধু শাসনত। তারা ছিল শিয়া কারামতিয়া ধর্মমতের অনুসারী।

দিল্লি ও আজমির: মুহাম্মদ ঘুরির আক্রমণের প্রাক্কালে দিল্লি ও আজমির ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য। রাজপুত চৌহান রাজবংশ দিল্লি ও আজমির শাসন করত। চৌহান রাজ বিশালদেবের সময় হারাকেলী’ ও ‘ললিতা নিগ্রহ রাজা’ নামের দুটি বিখ্যাত নাটক রচিত হয়েছিল।

কনৌজঃ কনৌজ ছিল তদানীন্তন ভারতের অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য। এ রাজ্যের রাজপুত শাসকগােষ্ঠী গহরওয়াল বংশ প্রতিবেশী দিল্লি ও আজমির রাজ্যের চৌহান রাজপুতদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।

বুন্দেলখণ্ড: মুহাম্মদ ঘুরির আক্রমণের প্রাক্কালে চান্দেলা বংশ স্বাধীন বুন্দেলখণ্ড রাজ্য শাসন ব্রত। ঝাসি, অজয়গর, কালিঞ্জার এবং মাহাবাে অঞ্চলগুলাে চান্দেলা বংশের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। পরমার্দি দেব দ্বিপেন ছিলেন এ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা।

গুজরাট: পশ্চিম ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল গুজরাট। এ রাজ্যের শাসকদের বংশ রাজপুত চালুক্য সমকালীন ভারতের অন্যতম শক্তিশালী রাজশক্তি হিসেবে গণ্য হতাে। গুজরাটের রাজধানী ছিল আনহিলওয়ার। সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুবাদে পশ্চিম উপকূলীয় এ রাজ্যটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছিল। মুহাম্মদ ঘুরির আক্রমণকালে এ রাজ্যের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ভীমদেব।

বিহার: পূর্ব ভারতের বিহার তখন পাল বংশের শাসনাধীনে ছিল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশ একাদশ শতক থেকে অবক্ষয়ের দিকে যেতে থাকে এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে পতনের দ্বারদেশে উপনীত হয়। এ সময় কর্নাটক থেকে আগত সেনরা পালদের অধিকৃত অঞল দখল করে নিতে থাকে এবং মুহাম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণের সময় পাল শাসন বিহারের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

বাংলা: এ সময় বাংলা ছিল সেন বংশের শাসনাধীনে। কর্নাটক থেকে আগত সেনরা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু। বিজয় সেন, বল্লাল সেন ছিলেন এ বংশের খ্যাতিমান শাসক। মুহাম্মদ ঘুরির আক্রমণের সময় লক্ষ্মণ সেন বাংলার শাসক ছিলেন। সুকৌশলে তাকে পরাজিত করে সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা দখল করেন।

বখতিয়ারের বাংলা জয়ের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাংলায় মুসলিম শাসনের ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়। উপরের আলােচনায় দেখা যায়, মুহাম্মদ ঘুরির অভিযানের প্রাক্কালে উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলাে পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত ছিল। রাজনৈতিক অনৈক্য, ভারতীয় রাজন্যবর্গের পারস্পরিক শত্রুতা মুহাম্মদ ঘুরির বিজয় এবং ভারতে স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকে সহজ করেছিল। সমকালীন ভারতের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ. বি. এম. হবিবুল্লাহ যথার্থই বলেছেন, “দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারত প্রকৃতপক্ষেই দেশ বিজয়ের নেশাগ্রস্ত তুর্কিদের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্রে পরিণত হয়।”

সামাজিক অবস্থা (Social Conditions)

মুহাম্মদ ঘুরির অভিযানের প্রাক্কালে ভারতের সামাজিক অবস্থাও ছিল বিশৃঙ্খল ও অরাজকতাপূর্ণ । অনাচার, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও কোন্দলে তখনকার সামাজিক পরিবেশ কলুষিত হয়ে ওঠে। এ সময় বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথা হিন্দু সমাজে প্রবল আকার ধারণ করে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি প্রধান বর্ণে বিভক্ত হিন্দু সমাজে ঐক্য ও সংহতি চরমভাবে বিনষ্ট হয়। জাত্যাভিমানী উচ্চবর্ণ হিন্দুদের চরম নিপীড়নের ফলে নিম্নবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে নিম্নবর্ণের অনেক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য চেতনা ও দেশাত্মবােধ গড়ে ওঠেনি। ফলে তারা বহিরাগত আক্রমণকারীদের মােকাবিলায় সম্মিলিত প্রতিরােধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *