বিতর্ক হলো কথার যৌক্তিক যুদ্ধ, যে কোনো বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বিতর্কে থাকে যুক্তি ও তত্ত্ব-উপাত্ত এবং তথ্যের সমারোহ। যুক্তি তর্কের নান্দনিক উপস্থাপনার কারণে বিতর্ক বোদ্ধারা অনেকেই বিতর্ককে ‘বিতর্ক শাস্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেন।
বিতর্কের নিয়ম
প্রথম বক্তাঃ পক্ষ দলের প্রথম বক্তা বিষয়টিকে সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়ন করবেন, বিষয়ের পক্ষে দলের অবস্থান স্পষ্ট করবেন এবং সম্ভাব্য দুএকটি যুক্তি খন্ডন করবেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের প্রথম বক্তা পক্ষ দলের প্রথম বক্তার দেয়া সংজ্ঞায়নের মেনে নেয়া অংশ বাদে যদি প্রয়োজন হয় বাকী মূল শব্দগুলোর সংজ্ঞায়ন করবেন, বিষয়ের বিপক্ষে দলের অবস্থান স্পষ্ট করবেন এবং ১ম বক্তার দু’চারটি যুক্তি খন্ডন করবেন।
দ্বিতীয় বক্তাঃ পক্ষ দলের দ্বিতীয় বক্তা বিপক্ষ দলের প্রথম বক্তার দেয়া দলীয় কৌশল ও অবস্থানের ব্যাখ্যা এবং তা খন্ডন করে বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি ও উদাহরণের মাধ্যমে প্রথম বক্তার দেয়া দলীয় অবস্থান আরও স্পষ্ট করে যাবেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের দ্বিতীয় বক্তাও পক্ষ দলের দ্বিতীয় বক্তার ন্যায় তার দলের পক্ষে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করবেন।
দলনেতাঃ পক্ষ দলের দলনেতা তার প্রথম ও দ্বিতীয় বক্তার বক্তব্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি ও উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টিকে তার দলের পক্ষে প্রমাণ করে যাবেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের দলনেতাও তার দলের পক্ষে বিষয়টিকে প্রমাণ করে যাবেন।
যুক্তি খন্ডন পর্বঃ পক্ষ দলের দলনেতা বিপক্ষ দলের তিনজন বক্তার প্রদত্ত যুক্তিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিগুলো ধরে ধরে খন্ডন করে তাদের যুক্তিকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করবেন।
অন্যদিকে বিপক্ষ দলের দলনেতাও পক্ষ দলের প্রদত্ত যুক্তিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিগুলো খন্ডন করে তাদের যুক্তিকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করবেন।
বিতর্কের সময় আয়োজক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবেন। তবে তা সাধারণত বিতর্কের মূল পর্বের জন্য প্রত্যেক বক্তা ৩-৫ মিনিট করে (এক মিনিট পূর্বে সতর্ক সংকেত বাজাতে হবে) ও যুক্তি খন্ডন পর্বে উভয় দলের দলনেতা ২ মিনিট করে সময় পাবেন (দেড় মিনিটে সতর্ক সংকেত বাজাতে হবে)।
বিতর্কে সাধারণত সংজ্ঞায়ন, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, তথ্য, তত্ত্ব ও উদাহরণ প্রদান, যুক্তি প্রয়োগ ও খন্ডন প্রভৃতি বিষয়ে নাম্বার প্রদান করা হয়ে থাকে।
সনাতনী বিতর্ক
বিতর্কের বেশ প্রাচীনকালীন এ ফরম্যাটটি বর্তমানে খুব একটি প্রচলিত না থাকলেও বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক বা স্কুল পর্যায়ের বিতর্কগুলো এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। বিতর্কের এ ধারায় ব্যাকরণিক জটিলতা অন্য যেকোনো ফরম্যাটের বিতর্ক থেকে যথেষ্ট কম। এখানে একটি নির্ধারিত বিষয়ের উপর পক্ষ দলের ও বিপক্ষ দলের তিনজন বক্তা (১ম বক্তা, ২য় বক্তা ও দলনেতা) পালাক্রমে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সনাতনী বিতর্কে সাধারণত প্রত্যেক বক্তা তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে পাঁচ মিনিট ও গঠনমূলক পর্বের বক্তব্য শেষে উভয় পক্ষের দলনেতারা যুক্তিখন্ডনের জন্যে অতিরিক্ত তিন মিনিট করে সময় পেয়ে থাকেন। সনাতনী বিতর্ক পরিচালনার দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকে ‘সভাপতি’ বা ‘মডারেটর’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এর প্রচলন কমে গেলেও বিতর্কের হাতেখড়ির জন্যে সনাতনী বিতর্ক যথার্থ।
সংসদীয় বিতর্ক
সংসদীয় বিতর্ক হচ্ছে হালের জনপ্রিয় ডিবেট ফরম্যাট। বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কের ক্ষেত্রে সংসদীয় বিতর্কের ব্যবহার সর্বাধিক হারে দেখা যায়। তবে সনাতনী বিতর্কের তুলনার এ বিতর্ক ব্যাকরণগতভাবে বেশ জটিল। উভয় পক্ষের বক্তাদের (প্রধানমন্ত্রী/বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী/উপনেতা, সংসদ সদস্য) প্রত্যেকে এখানেও পাঁচ মিনিট করে সময় পান তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে, কিন্তু এই পাঁচ মিনিট সময়ের মাঝে কৌশলগতভাবে প্রতিপক্ষ দল পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন, পয়েন্ট অফ অর্ডার বা পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আঘাত হানার পাশাপাশি নিজেদের জন্যে সুবিধা আদায় করে নিতে পারেন। গঠনমূলক পর্ব শেষে যুক্তিখন্ডন পর্বে প্রথমে বিরোধীদলীয় নেতা ও সর্বশেষে প্রধানমন্ত্রী তিন মিনিট করে অতিরিক্ত সময় পেয়ে থাকেন। ফরম্যাটের নামই যেহেতু সংসদীয় বিতর্ক, সুতরাং স্বাভাভিকভাবেই পুরো বিতর্কটি যিনি পরিচালনা করবেন তাকে ‘স্পিকার’ হিসেবে সম্বোধন করা হবে।
বিতর্ক কি সত্যের সন্ধান দেয় না?
বিতর্ক সত্যের সন্ধান দেয়- এই কথার চেয়ে বড় অবিদ্যা আর কিছু হতে পারে না। বিতর্ক কখনো সত্যের সন্ধান দেয় না। যারা বিতর্কে জড়িয়েছে, যে জাতিগুলোই যত বিতর্কে জড়িয়েছে সে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বিতর্ক এবং বাহাস একই জিনিস। এমনও সময় ছিলো যখন আমাদের দেশে বাহাস হতো দোয়ালিন ঠিক না যোয়ালিন ঠিক।
বাহাস নিয়ে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে যে দোয়ালিন করবে না যোয়ালিন করবে। অর্থাৎ বিতর্ক হচ্ছে শয়তানের একটা অস্ত্র, বিতর্ক দিয়ে কখনো কেউ সত্যের সন্ধ্যান পায় নি। এত বিতর্ক হচ্ছে, সত্যের সন্ধান কি পাওয়া গেছে? প্রত্যেকে যারা বিতর্কে অংশগ্রহণ করে তারা কী করে? তারা আসলে নিজে যে জিনিসটা বুঝলো সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় কূটতর্ক দিয়ে। এর পক্ষে কত যুক্তি আছে এবং আরেকজন সত্য বললে, সত্য জানার পরেও সে সত্য গ্রহণ করার জন্যে প্রস্ত্তত থাকে না। বিতর্ক সত্যবিমুখ হওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করে।
বিতর্ক কখনো সত্যে পৌঁছার মানসিকতা সৃষ্টি করে না, বিতর্ক সবসময় নিজের চিন্তাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার চেষ্টা করে। সত্য জানার চেষ্টার নাম বিতর্ক নয়, সত্য অনুসন্ধান এবং বিতর্ক আলাদা জিনিস, সত্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে আলোচনা এক জিনিস আর বিতর্ক হচ্ছে আরেক জিনিস। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। সত্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে আপনি একজনের সাথে গিয়ে আলোচনা করতে পারেন। সেই আলোচনা থেকে আপনি সত্যে পৌঁছতে পারবেন। কিন্তু আপনি যদি বিতর্ক করার জন্যে যান আপনি কখনোই সত্যে পৌঁছাতে পারবেন না।