নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনের জন্যে ভাষণ
সম্মানিত সভাপতি, আমন্ত্রিত আলােচকবৃন্দ ও সুধীবৃন্দ- আসসালামু আলাইকুম।
বহুমুখী প্রতিভার বিচিত্র দ্যুতি ললাটে ধারণ করে, বিদ্রোহের বীণায় ঝংকার তুলে বাংলা সাহিত্যাকাশে যে কবি সহসা আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি হলেন আমাদের বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৮৯৯ সালের এমনি এক দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নজরুল। আজ জন্মবার্ষিকে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা অর্পণ করতে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।
প্রিয় বন্ধুগণ,
এ কথা সবার জানা যে, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান সকল দেশপ্রেমিককে উৎসাহ জুগিয়েছে। আমরা তার কাছে আমাদের সমরসঙ্গীতের জন্য ঋণী। তিনি আমাদের আনন্দ-বেদনার সঙ্গী। আমরা তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে অভিহিত করে ধন্য হয়েছি। ধন্য কাজী নজরুল ইসলামের নাম। নজরুল তুমি আমাদের ধন্য করেছ। আমরা তােমারই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জয়ধ্বনি করি। তুমিই আমাদের শিখিয়েছ মানুষকে ভালােবাসতে, দেশের দুঃখী মানুষের কথা ভাবতে। কে এমন সহজভাবে গেয়েছে ‘চাষার গান’ বা ‘জেলের গান’।
সুধী,
প্রায় সাত দশক আগে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা অ্যালবার্ট হলে আমাদের জাতীয় কবি নজরুলকে যখন জাতীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় তখন তিনি একত্রিশ বছরের যুবক। এত অল্প বয়সে এরূপ সংবর্ধনা এক বিরল ব্যাপার। সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন : নজরুল কবি, প্রতিভাবান মৌলিক কবি। রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই; তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।
নজরুল সংবর্ধনা সমিতির সভাপতি এস ওয়াজেদ আলী বলেন, “ধুলার আসনে বসিয়া মাটির মানুষের গান গাহিয়াছ তুমি। সে-গান অনাগত ভবিষাতের। তােমার নয়ন সায়রে তাহার ছায়াপাত হইয়াছে। মানুষের ব্যথা বিষে নীল হইয়া যে তােমার কণ্ঠে দেখা দিয়াছে। ভবিষ্যতের ঋষি তুমি, চিরঞ্জীব মনীষী তুমি।’
প্রিয় সুধীবৃন্দ,
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তার এই বিদ্রোহমূলক দৃষ্টিভঙ্গির মূলে রয়েছে স্বদেশপ্রীতি, স্বাধীনতাপ্রীতি ও সাম্যবাদী মনােভাব। তার মতাে দৃপ্ত কণ্ঠে আর কোনাে বাঙালি কবি উচ্চারণ করতে পারে নি।
“লাথি মার- ভাঙরে তালা / যতসব বন্দীশালা-/ আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা।”
তিনিই একমাত্র কবি যিনি স্বদেশের প্রতি আনুগত্যের দায়ে বিদেশি শাসকের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং নিপীড়িতের জয়গান রচনায় নিজের লেখনীকে নিঃসংশয়ে উৎসর্গ করেছিলেন। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে যে-সব মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তা জগৎসভার মাঝে ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ হিসেবে গৃহীত হওয়ার পূর্বেই আমরা নজরুলের কাছ থেকে পেয়েছি। সংবিধানের ২৭, ২৮ ও অন্যান্য অনুচ্ছেদের কথাগুলাে সাদরে গ্রহণ করার জন্য নজরুল আমাদের মন ঠিক করে গিয়েছিলেন। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। কেবল ধর্ম, গােষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনাে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।
প্রিয় সাথিগণ,
নজরুল মানবতার কবি, সাম্যের কবি। তাঁর কাব্যের সর্বত্রই তিনি নিপীড়িত, শােষিত, লাঞ্ছিত-জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর সর্বহারা কাব্যের প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরুদ্ধে যেমন লিখেছেন, তেমনি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ, নারীর অবমাননা, নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধেও অবিরাম লিখে গেছেন। তিনি বলেছেন-
‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর। অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
আবার, নজরুল প্রেম ও সৌন্দর্যের পূজারিও ছিলেন। তাঁর কবিতাগুলাে তাকে স্থান দিয়েছে সমসাময়িকতার উর্ধ্বে। তার কাব্যে প্রেম প্রতিমা রূপ ধরে এসেছে, অতীত হয়ে উঠেছে জীবন্ত অশুদীপ্ত। তিনি বলেন,
‘মাের প্রিয়া হবে এস রাণী রানি, দেব খোঁপায় তারার ফুল।
আমাদের এই জাতীয় কবি নজরুলকে দু’চার কথার মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তিনি ব্যাখ্যার অতীত, তিনি আমাদের আদর্শ। তিনি আমাদের সমগ্র চেতনার মূল।
যার ছেলেবেলার নাম দুখু মিয়া, যিনি সারা জীবন দুঃখী মানুষের কথা বলে গেছেন। তার অন্তরের অন্তস্তল থেকে ডাক দিয়েছেন সেই ঈদ উৎসবের, যেদিন খুশির সওগাত দেশের প্রতিটি ঘরে পৌছে যাবে। নজরুলের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কঠিন সাধনা করতে হবে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে আমি সেই মহান মানবদরদি কবির দোহাই দিয়ে আকুল আবেদন জানাই আপনারা সকলে মিলে সব রেষারেষি ভুলে গিয়ে শান্তির-আবহ সৃষ্টি করবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।