দ্বন্দ্ব ও দ্বিগু সমাসের শ্রেণিবিভাগ ও নির্ণয়ের সহজ কৌশল

দ্বন্দ্ব সমাস

দ্বন্দ্ব সমাস সংযােজক অব্যয়ের লােপ পেয়ে এবং উভয় পদের (পূর্বপদ এবং পরপদ) অর্থেরই প্রাধান্য বজায় রেখে যে সমাস হয় তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন : মাতা ও পিতা মাতাপিতা; ভালাে ও মন্দ = ভালােমন্দ ইত্যাদি। এখানে মাতাপিতা বলতে মাতা ও পিতা এবং ভালােমন্দ বলতে ভালাে ও মন্দ উভয়কেই বােঝায়।

‘দ্বন্দ্ব’ শব্দের দুটো অর্থ— সংঘাত ও মিলন। সমাসের ক্ষেত্রে ‘মিলন’ অর্থটাই গৃহীত হয়। দ্বন্দ্ব সমাস’ মানে মিলনের সমাস। যে সমাসে দুই বা ততােধিক পদের মিলন হয় এবং সমস্যমান প্রত্যেক পদের অর্থই প্রধান থাকে, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। এই সমাসে ব্যাসবাক্য তৈরি করার জন্যে এবং, ‘ও’, ‘আর, ইত্যাদি সংযােজক অব্যয়ের সাহায্য নেওয়া হয়।

দ্বন্দ্ব সমাসের শ্রেণিবিভাগ

দ্বন্দ্ব সমাস নিম্নলিখিত কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন-

১। সাধারণ দ্বন্দ্ব

একাধিক পদের একত্র অবস্থানে দ্বন্দ্ব সমাস হলে তাকে সাধারণ দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন : কালি ও কলম = কালিকলম; লতা ও পাতা = লতাপাতা ইত্যাদি।

২। মিলনার্থক দ্বন্দ্ব

একাধিক পদের মিলন বােঝাতে দ্বন্দ্ব সমাস হলে তাকে মিলনার্থক দ্বন্দ্ব বলে। যেমন : চা ও বিস্কুট = চা-বিস্কুট; মা ও বাপ = মা-বাপ; জিন ও পরি = জিনপরি ইত্যাদি।

৩।সম্বন্ধবাচক দ্বন্দ্ব

যে দ্বন্দ্ব সমাসে সম্বন্ধ বােঝায় তাকে সম্বন্ধবাচক দ্বন্দ্ব বলে। যেমন : দম্ (জায়া) ও পতি দম্পতি, মাতা ও পিতা = মাতাপিতা ইত্যাদি।

8। সমার্থক দ্বন্দ্ব

দ্বন্দ্ব সমাসের পূর্বপদ এবং পরপদ একই অর্থ বহন করলে তাকে সমার্থক দ্বন্দ্ব বলে। যেমন : লজ্জা ও শরম = লজ্জাশরম; হাট ও বাজার = হাটবাজার; ঘর ও বাড়ি = ঘরবাড়ি। এ-রকম : আইনকানুন, ঠাট্টা-মশকরা, মণিমাণিক্য, মানসম, দুঃখকষ্ট, রাগরাগিণী, কোর্টকাছারি, রাজাবাদশা, দেখাসাক্ষাৎ, ধনসম্পত্তি, ধরপাকড়, সুখশান্তি, ছাইভস্ম, বাধাবিঘ্ন, জনমানব, জীবজন্তু, টাকাকড়ি ইত্যাদি।

৫। বিরােধার্থক বা বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব

দ্বন্দ্ব সমাসের পূর্বপদ এবং পরপদ বিপরীত অর্থ বহন করলে তাকে বিরােধার্থক বা বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব বলে। যেমন— ছােট ও বড় ছােটবড়; দা ও কুমড়া = দাকুমড়া; সুখ ও দুঃখ = সুখদুঃখ। এ-রকম : আকাশপাতাল, আসলনকল, গুরুশিষ্য, দিনরাত, ধনীদরিদ্র, রাজাপ্রজা, উচুনিচু, দেশবিদেশ, শহরগ্রাম, নরনারী, ছেলেমেয়ে, আজকাল, জন্মমৃত্যু, মরার্বাচা।

৬। একশেষ দ্বন্দ

যে দ্বন্দ্ব সমাসে প্রধান পদটি অবশিষ্ট থেকে অন্য পদের লােপ হয় এবং শেষ পদ অনুসারে যখন শব্দের রূপ নির্ধারিত হয় তখন তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব বলে। যেমন : সে, তুমি ও আমি = আমরা। এ- রকম : আপনারা, আপনাদের, আমাদের, তােমাদের, তােরা ইত্যাদি।

৭। অলুক দ্বন্দ

যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলাের বিভক্তি লুপ্ত না হয়ে সমস্ত পদেও যুক্ত থাকে তাকে অলুক দ্বন্দ্ব বলে। যেমন : কোলে ও পিঠে = কোলেপিঠে; দুধে ও ভাতে = দুধেভাতে ইত্যাদি। কোল, পিঠ, দুধ, ভাত— প্রত্যেক শব্দেই এখানে এ-বিভক্তি যুক্ত আছে। এ-রকম : আদায়-কাঁচকলায়, আগেপিছে, কাগজে-কলমে, ধীরেসুস্থে, ক্ষেতেখামারে, দলেদলে, দুঃখেসুখে, হাতেপায়ে, হাতেনাতে, থরেবিথরে, যাকেতাকে, ঝােপেঝাড়ে, ডাইনোয়ে, মনেপ্রাণে, জলেডাঙায়, পথেপ্রবাসে, পতনেউথানে ইত্যাদি। ৮। বহুপদী দ্বন্দ্ব : তিন বা বহু পদ মিলে দ্বন্দ্ব সমাস হলে তাকে বহুপদী দ্বন্দ্ব বলে। যেমন— তেল, নুন ও লাকড়ি = তেল-নুন-লাকড়ি; রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শ = রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-পর্শ। এ-রকম : পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ, বাল-বৃদ্ধ-বণিতা, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা, টক-ঝাল-মিষ্টি, সকাল-দুপুর- সন্ধ্যা-রাত, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, নাচ-গান-বাজনা ইত্যাদি।

দ্বন্দ্ব সমাস নির্ণয়ের সহজ কৌশল

দ্বন্দ্ব শব্দের অর্থ জোড়া। শব্দটি নিজেই এই সমাসের বৈশিষ্ট্যের আভাস দেয়।

  • এতে পূর্বপদ ও পরপদ একই বিভক্তিযুক্ত থাকে এবং উভয় পদের অর্থই প্রাধান্য পায়।
  • বিশেষ্য + বিশেষ্য; যেমন : আইন-আদালত, কাগজ-কলম, শহর-গ্রাম, হাত-পা, ভাবভঙ্গি, নাচ-গান, আদবকায়দা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ধনজন, রাজা-উজির, কীটপতঙ্গ, নথিপত্র, রীতিনীতি, পথঘাট, লােক-লস্কর, পুথিপত্র, পােকামাকড়, সভা-সমিতি, সৈন্যসামন্ত, ছাত্রছাত্রী, আঁকজমক, বেশভূষা, তালতমাল, হাতি-ঘােড়া ইত্যাদি।
  • বিশেষণ + বিশেষণ; যেমন : কাঁচা-পাকা, কানা-খোড়া, জানাশােনা, নরম-গরম, ভালাে-মন্দ, চেনা-অচেনা, হাসি-কান্না, দীন-দুঃখী, নিত্য-নৈমিত্তিক ইত্যাদি।
    ক্রিয়াবিশেষ্য-ক্রিয়াবিশেষ্য; যেমন : আসা-যাওয়া-ওঠা-বসা, লেখাপড়া, চলাফেরা, দেওয়া-নেওয়া, ক্রয়-বিক্রয়, খানাপিনা, পড়াশােনা, টানাহেঁচড়া, লম্ফঝম্ফ ইত্যাদি।
  • ক্রিয়াপদ-ক্রিয়াপদ; যেমন : মেরে-ধরে, হেসে-খেলে, ভেঙে-চুরে, চেয়েচিন্তে, হারি-জিতি, উঠে-পড়ে ইত্যাদি হতে পারে।
  • ব্যাসবাক্যে পূর্বপদ ও পরপদ এই প্রধান পদ দুটি এবং’, ‘ও’, ‘আর’ এই সংযােজক অব্যয়গুলাে দ্বারা যুক্ত থাকে। যেমন : কাপড় কিনতে যাচ্ছ? তাহলে আসল-নকল দেখে কিনবে। এখানে আসল এবং নকল যাদের শেষে একই বিভক্তি আছে শূেন্য বিভক্তি)। শব্দ দুটি সংযােজক অব্যয় এবং দ্বারা যুক্ত। এই অংশটুকু ব্যাসবাক্য। পূর্বপদ ও পরপদ আসল ও নকল দুটি পদের অর্থই প্রাধান্য পাচ্ছে কারণ শুধু আসল কিংবা শুধু নকলকেই বােঝানাে হচ্ছে না, আসল-নকল উভয়কেই বােঝানাে হচ্ছে।

দ্বিগু সমাস

যে সমাসে সংখ্যাবাচক শব্দ পূর্বে বসে সমাহার বােঝায় এবং পরপদের অর্থই প্রাধান্য পায় তাকে ‘দ্বিগু সমাস বলে। যেমন: নব রত্নের সমাহার = নবরত্ব, সপ্ত অহের সমাহার সপ্তাহ ইত্যাদি। অথবা, সমাহার (সমষ্টি) বা মিলনার্থে সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয় তাকে দ্বিগু। সমাস বলে। যেমন : ত্রি (তিন) কালের সমাহার = ত্রিকাল; তে (তিন) মাথার সমাহার = তেমাথা; শত অব্দের সমাহার = শতাব্দী, পঞ্চবটের সমাহার = পঞ্চবটী; ত্রি পদের সমাহার = ত্রিপদী ইত্যাদি।

দ্বিগু সমাস নির্ণয়ের সহজ উপায়

দ্বিগু সমাসে প্রথম পদটি সংখ্যাবাচক হয় এবং পরপদটি হবে বিশেষ্য। সমস্তপদটি দ্বারা সমষ্টি বা সমাহার বােঝায়। এবং বা সমস্তপদটি একটি বিশেষ্য পদ হয়। যেমন : তে (তিন) মাথার সমাহার = তেমাথা, নব (নয়) রত্নের সমাহার: নবরত্ব।

এই ছিলো তৎপুরুষ সমাস নিয়ে বিস্তারিত আর্টিকেল। আশাকরি আজকের আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। ভালো লাগলে আমাদের সাথেই থাকুন। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *