তৎপুরুষ সমাস নির্ণয়ের সহজ উপায়

তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণিবিভাগ ও তৎপুরুষ সমাস নির্ণয়ের সহজ উপায়

যে সমাসে পরপদের অর্থ প্রধান বলে বিবেচিত হয় এবং পূর্বপদের দ্বিতীয়াদি বিভক্তি লােপ পায় তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। আরও বিস্তৃতভাবে বললে বলা যায়, পূর্বপদে কর্ম প্রভৃতি কারকের বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গযুক্ত পদের সঙ্গে অথবা সম্বন্ধপদের সঙ্গে সমাস হয়ে যদি পরপদের অর্থ-প্রাধান্য থাকে তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন : ধানের ক্ষেত = ধানক্ষেত, ভাতকে রাঁধা = ভাতরাধা ইত্যাদি । এ সমাসে পূর্বপদে দ্বিতীয়া থেকে সপ্তমী পর্যন্ত বিভক্তি থাকে এবং সমাস গঠনের ফলে সে সব বিভক্তি লােপ পায়।

তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণিবিভাগ

তৎপুরুষ সমাস নয় প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন :

১। দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের দ্বিতীয়া বিভক্তি (কে, রে ইত্যাদি) লােপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয়, তাকে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে। দ্বিতীয়া বিভক্তির চিহ্ন কে, রে। যেমন : গাকে ঢাকা গা-ঢাকা, বই-পড়া ইত্যাদি। এ-রকম : আত্মরক্ষা, আত্মহত্যা, কাপড়-কাচা, গুনটানা, জাতিগত, দর্পচূর্ণ, দুঃখপ্রাপ্ত, নারী-নির্যাতন, পদত্যাগ, চুক্তি-সম্পাদন, বৃত্তিপ্রাপ্ত, বুকজুড়ানাে, দেশত্যাগ, প্রাণনাশ, ফুলতােলা, বর্ণনাতীত, বিপদাপন্ন, ব্যক্তিগত, হস্তগত, রেখাপাত, মর্মগত, মজ্জাগত ইত্যাদি।

  • ব্যাপ্তি অর্থে কালবাচক পদের সঙ্গে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ হয়। যেমন : চিরকাল ধরে সুখ = চিরসুখ, ক্ষণকাল রয়ে ধরে স্থায়ী = ক্ষণস্থায়ী ইত্যাদি। এ-রকম : চিরকুমারী , চিরকৃতজ্ঞ, চিরদুঃখী, চিরবঞ্চিত, চিরবসন্ত, চিরশত্রু, চিরস্থায়ী, চিরস্মরণীয়, দীর্ঘস্থায়ী ইত্যাদি।
  • পূর্বপদটি বিশেষণের বিশেষণ বা ক্রিয়া-বিশেষণ হলে পরবর্তী কৃদন্ত পদের সঙ্গে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ হয়। যেমন: অর্ধরূপে সিদ্ধ = অর্ধসিদ্ধ, আধভাবে মরা = আধমরা ইত্যাদি।

২। তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের তৃতীয়া বিভক্তি (দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক ইত্যাদি) লােপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাসলেব্বির, দিয়া কর্তৃক এসব তৃতীয়া বিভক্তি। যেমন : মন আরা গড়া = মনগড়া; শ্রম দ্বারা লম্ব= শ্রমলব্ধ, মধু দিয়ে মাখা = মধুমাখা ইত্যাদি।

  • উন, হীন, শূন্য প্রভৃতি শব্দ উত্তরপদ হলেও তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যথা- এক দ্বারা উন= একোন, বিদ্যা দ্বারা হীন = বিদ্যাহীন, জ্ঞান দ্বারা শূন্য = জ্ঞানশূন্য ইত্যাদি।
  • উপকরণবাচক বিশেষ্যপদ পূর্বপদে বসলেও তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন : স্বর্ণ দ্বারা মণ্ডিত = অস্ত্রাঘাত, আইনসংগত, ঋণগ্রস্ত, কণ্টকাকীর্ণ, কুরুচিপূর্ণ, কষ্টার্জিত, ক্ষতিগ্রস্ত, গুণান্বিত, ঘটনাবহুল, চন্দনচর্চিত, চিনিপাতা, ছন্দোবদ্ধ, ছায়াশীতল, ছুরিকাঘাত, ছায়াচ্ছন্ন, ঝাঁটাপেটা, টেকিছুটা দুখপােষ্য, ধর্মান্ধ, প্রথাবদ্ধ, প্রীতিপূর্ণ, বায়ুচালিত, বিকারগ্রস্ত, বিজ্ঞানসম্মত, ভারাক্রান্ত, মন্ত্রমুগ, রাহুগ্রস্ত, রােগগ্রস্ত, শস্যশ্যামল, সর্পদষ্ট, হীরকখচিত ইত্যাদি।

৩। চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের চতুর্থ বিভক্তি (কে, রে ইত্যাদি) লােপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস বলে। চতুর্থ বিভক্তির চিহ্ন কে, রে। নিমিত্ত বা জন্য অর্থেও চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন : দেবকে দত্ত = দেবদত্ত; বিয়ের জন্যে পাগল = বিয়েপাগল। এ-রকম : অতিথিশালা, আক্কেলসেলামি, এতিমখানা, ঔষধালয়, কাদানেগ্যাস, কিশাের পত্রিকা, গুরুভক্তি, ছাত্রাবাস, জিয়নকাঠি, ডাকখরচ, পাঠশালা, পাগলাগারদ, পাঠকক্ষ, পান্থশালা, পান্থনিবাস, ফাসিকাষ্ঠ, বসতবাড়ি, মুক্তিপণ, বিশ্রামঘর, বৈঠকখানা, ভজনালয়, ভােজনালয়, শিশুবিভাগ, হজযাত্রা, স্বদেশপ্রেম, সভামঞ্চ ইত্যাদি।

  • উদ্দেশ্য বােঝাতে নিমিত্তার্থে চতুর্থী তৎপুরুষ হয়। তখন এর জন্যে’, ‘এর নিমিত্ত’, ‘এর তরে’ ইত্যাদি যুক্ত হয়। যেমন : মাপের জন্যে কাঠি = মাপকাঠি; বসতের জন্যে বাড়ি = বসতবাড়ি ইত্যাদি।

৪। পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের পঞ্চমী বিভক্তি (হতে, থেকে ইত্যাদি) লােপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস বলে। হতে, থেকে, চেয়ে – এসব পঞ্চমী বিভক্তির চিহ্ন। যেমন: পরানের চেয়ে প্রিয় = পরানপ্রিয়; বিলাত থেকে ফেরত বিলাতফেরত; বদ থেকে জাত = বজ্জাত ইত্যাদি। কণ্ঠনিঃসৃত, , দুগ্ধজাত, বোটাখসা, স্বর্গচ্যুত, ঋণমুক্ত, কারামুক্ত, কৃষিজাত, খাঁচাছাড়া, গদিচ্যুত, দলচ্যুত, বৃন্তচ্যুত, লক্ষ্যচ্যুত, চাকভাঙা, জেলফেরত, দলছুট, দলভ্রষ্ট, পথভ্রষ্ট, সত্যভ্রষ্ট, বন্ধনমুক্ত, বিক্রয়লব্ধ, বিদেশাগত, মেঘমুক্ত, শাপমুক্ত, রােগমুক্ত, কুলপালানাে, স্নেহবঞ্চিত, হাতছাড়া ইত্যাদি।

  • সাধারণত চ্যুত, জাত, আগত, ভীত, গৃহীত, বিরত, মুক্ত, উত্তীর্ণ, পালানাে, ভ্রষ্ট ইত্যাদি পরপদের সঙ্গে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস হয়। কোনাে কোনাে সময় পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাসের ব্যাসবাক্যে এর’, ‘চেয়ে’ ইত্যাদি অনুসর্গের ব্যবহার হয়। যথা : পরানের চেয়ে প্রিয়। = পরানপ্রিয়।

লক্ষ কর

‘হতে’ ও ‘থেকে’— এর প্রয়ােগ : ‘হইতে’ সাধুরীতি— এর চলিতরীতি ‘থেকে’ বা ‘হতে’ ‘থেকে বা ‘হতে’র প্রয়ােগ ভিন্নধর্মী। হতে’ কবিতায় ব্যবহৃত হয়। যেমন : ‘আমি দূর হতে তােমাকে দেখেছি। ‘হইতে’-এর চলিত রূপ হিসেবে ‘থেকে’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : সে কলেজ থেকে এসেছে। তবে ‘হওয়া’ অর্থে ‘হতে’ প্রয়ােগ হয়। যেমন : বড় যদি হতে চাও ছােট হও তবে। হইতে’-এর চলিত রূপ ‘থেকে’ বােঝাতে হতে’ ব্যবহার ঠিক নয়। কলেজ হতে এসেছি’ না হয়ে হওয়া উচিত ‘কলেজ থেকে এসেছি।

৫। ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের ষষ্ঠী বিভক্তি (র, এর ইত্যাদি) লােপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস বলে। ষষ্ঠী বিভক্তির চিহ্ন ‘র’, ‘এর। যেমন : বটের তলা = বটতলা; ঘােড়ার গাড়ি ঘােড়গাড়ি । রান্নার ঘর = রান্নাঘর ইত্যাদি। এ-রকম : অশ্বডিম্ব, কবিগুরু, কর্মকর্তা, কর্মক্ষেত্র, কর্মাধ্যক্ষ, কার্যক্রম, কার্যনির্বাহক, কালপ্রবাহ, কল্পনাশক্তি, ক্ষতচিহ্ন, খাদ্যপ্রাণ, গঠনপ্রণালি, গৃহকর্তা, গৃহসজ্জা, গ্রন্থাগার, ঘােড়দৌড়, চন্দ্রগ্রহণ, ছাত্রসমাজ, জগৎস্রষ্টা, জাহাজঘাট, জীবনচরিত, জ্ঞানতাপস, ঝিঙেফুল, টিকিটঘর, ঠাকুরঘর, তত্ত্বানুসন্ধান, দমননীতি, দলনেতা, দলপতি, দাসত্বপ্রথা, দেশবন্ধু, দেহাতীত, ধর্মচর্চা, ধর্মসংস্কার, ধানক্ষেত, ধারণাতীত, নদীতট, নদীতীর, নির্মাণকৌশল, নীতিবিরুদ্ধ, পথখরচ, পদোন্নতি, পরাধীন, পর্যায়ক্রম, পল্লি-উন্নয়ন, পুকুরঘাট, প্রশ্নমালা, ফুলকলি, বর্ণমালা, বাশঝাড়, বাহুবল, বিশ্বনবী, বিশ্বাসঘাতক, বৃক্ষছায়া, বােধােদয়, ভগ্নিপতি, ভাগ্যফল, ভাবাবেগ, ভাববাচ্ছাস, মনােভাব, মানহানি, মায়াডাের, মুক্তিপিপাসা, মুখভঙ্গি, মৃত্যুশয্যা, রণকৌশল, রাজকন্যা, রাজপ্রাসাদ, রাশিচক্র, রাষ্ট্রপতি, লীলাভূমি, লােকনিন্দা, লােকালয়, শব্দকোষ, শয়নকক্ষ, শােকাতীত, শােকোজ্জ্বাস, শ্বশুরবাড়ি, সংখ্যাতীত, সভাগৃহ, সভানেত্রী, সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি।

জ্ঞাতব্য

  • ৬ষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসে ‘রাজা’ শব্দটি থাকলে তা হয়ে যায় ‘রাজ’। যেমন : রাজার কন্যা = রাজকন্যা, রাজার পুত্র = রাজপুত্র ইত্যাদি। ‘রাজা’ শব্দটি ‘king’ অর্থে ব্যবহৃত হলে, এবং ব্যাসবাক্যে তা পরে থাকলে, সমস্তপদে তা পরেই থাকে। যেমন : গজনীর রাজা = গজনীরাজ, বঙ্গোর রাজা * বরাজ ইত্যাদি। কিন্তু রাজা’ শব্দটি যদি শ্রেষ্ঠ অর্থে ব্যাসবাক্যে পরে ব্যবহূত হয়, তাহলে তা সমস্তপদে আগে চলে আসে। যেমন : পথের রাজা = রাজপথ, ইসের রাজা * রাজহাঁস ইত্যাদি।
  • পিতা, মাতা, ভ্রাতা- এই শব্দ তিনটির সঙ্গে ৬ষ্ঠী বিভক্তি যুক্ত থাকলে, সমস্তপদে সেগুলাে যথাক্রমে পিতৃ, মাতৃ, ভ্রাতৃ হয়ে যায়। যেমন : পিতার ধন পিতৃধন, ম্যতার সেবা-মাতৃসেবা, ভাতার তুল্য= ভ্রাতৃতুল্য ইত্যাদি।
  • পরপদে সহ, তুল্য, নিভ, প্রায়, সহ, প্রতিম এ-সব শব্দ থাকলেও যষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন : পত্নীর সহ = পত্নীসহ, কন্যার সহ – কন্যাসহ, সহােদরের প্রতিম – সহােদরপ্রতিম/স্যেদরপ্রতিম ইত্যাদি।
  • কালের কোনাে অংশ পরে থাকলে তা পূর্বে বসে। যেমন- অহ্নের (দিনের) পূর্বভাগ = পূর্বানু।
  • পরপদে রাজি, ঘাম, বৃন্দ, গণ, যুথ প্রভৃতি সমষ্টিবাচক শব্দ থাকলে যষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন- ছাত্রের বৃন্দ = ছাত্রবৃন্দ, গুণের গ্রাম – গুণগ্ৰাম ইত্যাদি। এরূপ থরাজি, লেখকগণ, হস্তিযূথ ইত্যাদি।
  • অর্ধ’ বা ‘মাঝ’ শব্দটি ব্যাসবাক্যে পরে থাকলে সমতপদে আগে চলে আসে, অর্থাৎ ‘অধ’ শব্দ পরপদ হলে সমস্তপদে তা পূর্বপদ হয়। যেমন : সেরের অর্ধ = অর্ধসের, পথের অর্ধ = অর্ধপথ ইত্যাদি।
  • ৬ষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের ঈ (ইনজাত) (ী)-কারযুক্ত শব্দ ই (ি)-কারযুক্ত হয়। যেমন : মন্ত্রীর গণ = মন্ত্রিগণ, স্বামীর গৃহ = যামিগৃহ ইত্যাদি।
  • শিশু, দুস্থ, অণ্ড (ডিম), ডিঘ ইত্যাদি শব্দ পরে থাকলে ব্যাসবাক্যে তার আগে স্ত্রীবাচক শব্দ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্তপদে এই স্ত্রীবাচক শব্দগুলাের স্ত্রী-প্রত্যয় ‘ঈ (ী) লুপ্ত হয়ে সেগুলাে পুরুষবাচক হয়ে যায়। যেমন : হংসীর ডিম্ব = হংসেডিঘ, কুকুরীর ছানা = কুকুরছানা।

৬। সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের সপ্তমী বিভক্তি (এ, য়, তে) লােপ পেয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস বলে। এ, য়, তে – এগুলাে সপ্তমী বিভক্তির চিহ্ন। যেমন : দানে বীর = দানবীর; গাছে পাকা গাছপাকা; মাথায় ব্যথা মাথাব্যথা; গলাতে ধাক্কা গলাধাক্কা ইত্যাদি।

এ-রকম: অকালপক্ব, জলমগ্ন, মহাকাশভ্রমণ, ঝুড়িতি, শ্রুতিমধুর, অকালমৃত্যু, অধ্যয়নরত, আকাশভ্রমণ, কর্মকুশল, কর্মনিপুণ, কার্যক্ষম, গুণমুগ্ধ, গৃহবন্দি, ঘরপােড়া, চরণাশ্রিত, চিন্তামগ্ন, দেশবিখ্যাত, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মভীরু, ধ্যানমগ্ন, পাঠানুরাগ, পাঠরত, পানিবন্দি, বনবাস, বনভােজন, বাক্সবন্দি, বিশ্ববিখ্যাত, ভােজনপটু, রণনিপুণ, রৌদ্রদগ্ধ, শক্তিহীন, সংখ্যালঘু, শিরােধার্য, শয্যাশায়ী ইত্যাদি।

লক্ষণীয়: সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসে কখনাে কখনাে ব্যাসবাক্যের পূর্বপদটি পরে বলে। যেমন অভূতপূর্ব : পূর্বে অভূত; ভূতপূর্ব : পূর্বে ভূত, অদৃষ্টপূর্ব : পূর্বে অদৃষ্ট ইত্যাদি।

৭। নঞ তৎপুরুষ সমাস :

পূর্বপদে নঞর্থক বা না-বাচক অব্যয় (না, নেই, নাই, নয়) ব্যবহৃত হয়ে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে নঞ তৎপুরুষ সমাস বলে। নঞ তৎপুরুষ সমাসে নএ- এর অর্থ না। নঞ-এর আদি উচ্চারণ নং বা নইং। নঞর্থক অব্যয়গুলাে হল- নয়, না, নেই, অ, অন্, অনা, আ, গর, ন, নি, বি, ইত্যাদি। ন (নঞ) স্বরবর্ণের আগে বললে ‘অন্’ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের আগে বললে ‘অ’ হয়। ন তৎপুরুষের উদাহরণ : নয় অধিক = অনধিক; নেই অভ্যাস = অনভ্যাস; নয় জানা। অজানা; ন ভাব = অভাব; ন কাল = অকাল; নয় রাজি নারাজ; নয় ধােয়া = আধােয়া; নয় হাজির = গরহাজির; নয় হিসাবি = বেহিসাবি ইত্যাদি।

নঞ তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ

  • পূর্বপদে অ: যেমন : অকাতর, অকথ্য, অকপট, অকেজো, অক্ষম, অক্ষুন্ন, অখ্যাত, অচল, অচেনা, অজ্ঞাত, অধৈর্য, অনিবার্য, অফুরন্ত, অপরিণত, অপ্রিয়, অব্যক্ত, অম্লান, অভয়, অভদ্র, অসময় ইত্যাদি।
  • পূর্বপদে অন্/অনা: যেমন : অনুদার, অনভিজ্ঞ, অনশন, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাদি, অনাবশ্যক, অনাবৃষ্টি, অনাহূত, অনিচ্ছা, অনিষ্ট, অনুর্বর ইত্যাদি।
  • পূর্বপদে আ: যেমন: আলুনি, আকাড়া, আগাছা ইত্যাদি।
  • পূর্বপদে গর: যেমন: গরমিল, গরহাজির, গররাজি ইত্যাদি।
  • পূর্বপদে ন/না : যেমন : নাতিদীর্ঘ, নাবালক, নাখােশ, না-জানা, না-বলা, নাছােড়বান্দা, নারাজ, না- মঞ্জুর ইত্যাদি।
  • পূর্বপদে নি/নির: যেমন : নিখুঁত, নিরাশা, নিরামিষ, নিরুৎসাহ ইত্যাদি।
  • পূর্বপদে বি/বে: যেমন : বিদেশ, বিপাক, বেআইনি, বেকায়দা, বেজোড়, বেসরকারি, বেহিসাব ইত্যাদি।

৮। উপপদ তৎপুরুষ সমাস

কৃদন্ত পদের সঙ্গে উপপদের যে সমাস হয় তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন : অগ্রে গমন করে যে = অগ্রগামী। এখানে ‘গামী’র স্বতন্ত্র প্রয়ােগ নেই। অগ্রে গামী বললে চলবে না, ব্যাসবাক্য হবে ‘অগ্রে গমন করে যে’। এরূপ ধামা ধরে যে = ধামাধরা; ছেলে ধরে যে = ছেলেধরা ইত্যাদি।

কৃৎ প্রত্যয়ান্ত শব্দের আগে উপসর্গ ছাড়া অন্য পদ থাকলে তাকে উপপদ বলে। অথবা, যে পদের পরবর্তী ক্রিয়ামূলের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয় সে পদকে উপপদ বলে। কুম্ভকার = ক + কৃ + অ— এখানে ‘কুম্ভ’ উপপদ। কুভ করে যে = কুম্ভকার- উপপদ তৎপুরুষ সমাস। কোনাে পদ বিশ্লেষণ করলে যদি প্রথমে একটি পদ, তারপর একটি ধাতু এবং শেষে একটি প্রত্যয় পাওয়া যায়, তাহলে প্রথম পদটিকে বলে উপপদ।

উপপদ তৎপুরুষের উদাহরণ: অগ্রজ, আত্মজ, পঙ্কজ; মাছিমারা, ইদুরমারা (কল); ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকার কুত করে যে, জলচর, খেচর, নিশাচর, নভশ্চর; স্বর্ণকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার; গণিতজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ; গাঁটকাটা, পকেটকাটা; পদস্থ, তটস্থ, গৃহস্থ, দ্বারস্থ, মুখস্থ, পঙ্কজ, প্রকৃতি, পাত্র, ছন্নছাড়া, জলদ জিল দেয় যে, দলছাড়া, ঘরছাড়া; পরজীবী, চিরজীবী, বুদ্ধিজীবী, শত্রুঘ্ন শিত্রুকে হত্যা করে যে, শ্রমজীবী; পথহারা, গৃহহারা, বাস্তুহারা, দিশাহারা; চিত্রকর, মধুকর, বাজিকর, জাদুকর; আকাশচারী; সুবিধাভােগী, বেতনভােগী, ভুক্তভােগী। অস্ত্রধারী, ভেকধারী, জটাধারী; পারদর্শী, দুস্থ দুঃখে থাকে যে, দূরদর্শী; অস্তগামী, ধীরগামী, দুতগামী।

৯। অলুক তৎপুরুষ সমাস

পূর্বপদের বিভক্তি লােপ না পেয়ে তৎপুরুষ সমাস হলে তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। অলুক’ শব্দের অর্থ অ-লােপ, অর্থাৎ লােপ না হওয়া। যেমন: সােনার তরী = সােনার তরী; চিনির বলদ = চিনির বলদ, তেলে ভাজা = তেলেভাজা; খেলার মাঠ = খেলার মাঠ ইত্যাদি।

[গায়ে-হলুদ, হাতে-খড়ি প্রভৃতি সমস্তপদে পরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় না অর্থাৎ হলুদ বা খড়ি বােঝয় না, অনুষ্ঠান বিশেষকে বােঝায়। সুতরাং এগুলাে অলুক তৎপুরুষ সমাস নয়, অলুক বহুব্রীহি সমাস।]

সবরকম তৎপুরুষ সমাসই অলুক হতে পারে। যেমন:

  • অলুক তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস: যেমন : চোখ দিয়ে দেখা = চোখে-দেখা। এ-রকম : কলে-ছাঁটা, ঘিয়ে- ভাজা, জলে-ভেজা, দায়ে-কাটা, পায়ে-চলা, পােকায়-কাটা, বাশে-বাঁধা, বানে-ভাসা, রঙে-আঁকা, রােদে-পােড়া, শিশিরে-ভেজা, সাপে-কাটা, সুরে-বাধা, হাতে-গড়া ইত্যাদি। এগুলােকে অলুক সপ্তমী অ তৎপুরুষ সমাস হিসেবে বিবেচনা করাই সংগত।
  • অলুক চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস: যেমন : খেলার জন্যে মাঠ = খেলার মাঠ। এ-রকম : চায়ের কাপ, গায়ের চাদর, নাচের নূপুর, তেলের শিশি, পড়ার টেবিল, পাকের ঘর ইত্যাদি। এগুলােকে অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হিসেবে বিবেচনা করাই সংগত।
  • অলুক পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস: যেমন : ঘানি থেকে তেল = ঘানির তেল। এ-রকম : তিলের তেল, নিরম জল, নাকের জল ইত্যাদি। এগুলােও অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্ভুক্ত।
  • অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস: যেমন : খবরের কাগজ = খবরের কাগজ। এ-রকম : চিনির কল, গরুর দুধ, চোখের বালি, টাকার কুমির, ডুমুরের ফুল, তাসের ঘর, পায়ের চিহ্ন, মনের মানুষ, মামার বাড়ি, মগের মুল্লুক ইত্যাদি।
  • অলুক সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস: যেমন : অরণ্যে রােদন – অরণ্যে রােদন। এ-রকম : কলেজে পড়া, কলে ছাঁটা, গােড়ায় গলদ, ঘিয়ে-ভাজা, ছাঁচে ঢালা, দায়ে ঠেকা, দিনে ডাকাতি, নাকে খত, পায়ে ধরা, মনে রাখা, সােনায় সােহাগা, দায়ে পড়া ইত্যাদি।

তৎপুরুষ সমাস নির্ণয়ের সহজ উপায়

তৎপুরুষ সমাসের সমস্তপদে পূর্বপদের বিভক্তি লােপ পায়।

পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়। যেমন : সে রাজার পুত্র। এ বাক্যটিতে ‘রাজার’ এবং ‘পুত্র’—এ দুটি শব্দের প্রথমটির সঙ্গে ৬ষ্ঠী বিভক্তির চিহ্ন ‘র’ যুক্ত থেকে শব্দ দুটির মধ্যে একটি সম্বন্ধ বােঝাচ্ছে। এই ৬ষ্ঠী বিভক্তি বাদ দিয়ে ‘রাজ’ এবং ‘পুত্র’ শব্দ দুটিকে পাশাপাশি জুড়ে দিয়ে তাদের একটিমাত্র শব্দে পরিণত করা যায়। তা হল ‘রাজপুত্র। অর্থাৎ পূর্বপদের বিভক্তি চিহ্ন লােপ পেল। আবার রাজপুত্র শব্দটির মধ্যে দুটি শব্দ মিশে আছে— রাজা এবং পুত্র। কিন্তু শব্দটি দ্বারা রাজাকে বােঝানাে হচ্ছে না। বােঝানাে হচ্ছে তার পুত্রকে। অর্থাৎ পূর্বপদ এবং পরপদ উভয় দ্বারা কেবল পরপদকে বােঝাচ্ছে। তাহলে দেখা যায় যে, পরপদের অর্থই প্রাধান্য পাচ্ছে।

তৎপুরুষ সমাসে কোন্ বিভক্তি কীভাবে লুপ্ত হচ্ছে এটা জানাই প্রধান কাজ। আর এজন্য বিভক্তিগুলাে জানতে হবে।

২য়া তৎপুরুষ সমাস: এ সমাসে ব্যাসবাক্যে ২য়া বিভক্তির চিহ্ন ‘কে’, ‘রে থাকবে এবং সমস্তপদে বিভক্তির চিহ্নগুলাে থাকবে না, লােপ পাবে। যেমন : বইকে পড়া বইপড়া, ভাতকে রাধা = ভাতরাধা, শােককে অতীত = শােকাতীত ইত্যাদি। ব্যাপ্তি বােঝালেও ২য়া তৎপুরুষ সমাস হয়।

৩য়া তৎপুরুষ সমাস: এ সমাসে ব্যাসবাক্যে ৩য়া বিভক্তির চিহ্ন দ্বারা’, ‘দিয়া’, ‘কর্তৃক থাকবে এবং সমস্তপদে বিভক্তির চিহ্নগুলাে থাকবে না, লােপ পাবে। যেমন : মন দ্বারা গড়া = মনগড়া, টেকি দ্বারা ছাটা = চেঁকিছাটা, মধু দিয়ে মাখা = মধুমাখা ইত্যাদি।

কখনও কখনও সমস্যমান পদের দ্বারা বিভক্তির পরিবর্তে সমস্তপদে ‘এ’ বিভক্তির আগম ঘটে। এ জাতীয় সমাসের আলােচনা সাধারণত অলুক তৎপুরুষ সমাসের আলােচনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন : তেল দ্বারা ভাজা তেলেভাজা (তেল-ভাজা নয়। তেল + এ = তেলে), কল দ্বারা ছাঁটা = কলেছাটা (কল + এ =কলে), তাত দ্বারা বােনা = তাঁতেবােনা ইত্যাদি।

৪র্থী তৎপুরুষ সমাস: এ সমাসে ব্যাসবাক্যে ৪র্থ বিভক্তির চিহ্ন ‘কে’, ‘রে’ এবং জন্য, তরে, নিমিত্ত ইত্যাদি অনুসর্গ থাকবে এবং সমস্তপদে বিভক্তির চিহ্নগুলাে থাকবে না, লােপ পাবে। এই সমাসে সচরাচর পূর্বপদের উদ্দেশ্যে কিছু করা হয় এরূপ বােঝায়। যেমন : দেবকে দত্ত = দেবদত্ত, বসতের জন্যে বাড়ি = বসতবাড়ি ইত্যাদি।

৫মী তৎপুরুষ সমাস: এ সমাসে ব্যাসবাক্যে ৫মী বিভক্তির চিহ্ন হতে’, ‘থেকে’, ‘চেয়ে থাকবে এবং সমস্তপদে বিভক্তির চিহ্নগুলাে থাকবে না, লােপ পাবে। যেমন : জেল থেকে মুক্ত জেলমুক্ত, বৃক্ষ থেকে চ্যুত = বৃক্ষচ্যুত, গাছ থেকে পড়া = গাছ-পড়া ইত্যাদি।

৬ষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস: এ সমাসে ব্যাসবাক্যে, ৬ষ্ঠী বিভক্তির চিহ্ন ‘র’, ‘এর’ থাকবে এবং সমস্তপদে বিভক্তির চিহ্নগুলাে থাকবে না, লােপ পাবে। যেমন: বটের (বট-এর) তলা = বটতলা, তালের গাছ = তালগাছ, গৃহের স্বামী = গৃহস্বামী ইত্যাদি।

৭মী তৎপুরুষ সমাস: এ সমাসে ব্যাসবাক্যে ৭মী বিভক্তির চিহ্ন ‘এ’, ‘য়’, ‘তে থাকবে এবং সমস্তপদে বিভক্তির চিহ্নগুলাে থাকবে না, লােপ পাবে। যে শব্দের সঙ্গে ৭মী ‘এ’, ‘য়’, ‘তে’ বিভক্তি যুক্ত হয় তা কোন থান, সময় বা বিষয়কে বােঝায়। যেমন : গাছে (গাছ + এ) পাকা = গাছপাকা, রাতে কানা।

অলুক তৎপুরুষ সমাস: অলুক = ন (নাই) লুক (লােপ) যার। অর্থাৎ পূর্বপদে বিভক্তির লােপ হয় না। সমস্তপদ এবং ব্যাসবাক্য একই থাকে। যেমন: মায়ের দোয়া = ‘মা-দোয়া’ না হয়ে হবে ‘মায়ের দোয়া, কলের গান = ‘কলগান’ না হয়ে কলের গান’ হবে ইত্যাদি।

নঞ তৎপুরুষ সমাস: ব্যাসবাক্যের প্রথমে নহে/নয়/নাই’ শব্দ থাকবে এবং ব্যাসবাক্য দ্বারা না-বােধক অর্থ প্রকাশ করবে। যেমন : ন (নহে/নয়/নাই’) উক্ত = অনুক্ত, ন কাল অকাল ইত্যাদি।

এই ছিলো তৎপুরুষ সমাস নিয়ে বিস্তারিত আর্টিকেল। আশাকরি আজকের আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। ভালো লাগলে আমাদের সাথেই থাকুন। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *