রূপতত্ত্বের ভূমিকা ও শব্দগঠন সম্পর্কে বিস্তারিত

রূপতত্ত্বের ভূমিকা ও শব্দগঠন

রূপতত্ত্বের দুটি এলাকা । শব্দনির্মাণ ও পানিৰ্মাণ । শব্দনির্মাণ ও পদনির্মাণের কাজ ব্যাকরণের যে অংশে হয় তার নাম রূপতত্ত্ব (morphology)। পাশ্চাত্য ভাষাবিজ্ঞানে শব্দ (word) একটি সরল ধারণা, যেমন সেখানে affix বা শাক-এর ধারণা। সেখানে affix-কে যান্ত্রিকভাবে prefix, infix এবং suffix বা লগ্নক- এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, এবং যথাক্রমে শব্দের আদিতে, মধ্যে বা অন্তে এগুলির যোগ দেখিয়ে নতুন শব্দ নির্মাণের প্রক্রিয়া বােঝানাে হয়।

প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণশারে ‘শব্দ’ ও ‘গ’- এ দুটি ধারণার মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য করা হয়েছে, পাশ্চাত্য ব্যাকরণে তা সচরাচর লক্ষ করা হয় না। ইংরেজি ভাষায় word বলে যে শব্দটি চলে, তারও দুটি ধরন আছে। সরল হােক, জটিল সােধিত) হােক, এক ধরনের শব্দ থাকে অভিধানে, তার নির্মাণের অর্থাৎ জটিল শব্দের নির্মাণের প্রকরণ একরকম।

অভিধানের জটিল শব্দগুলি নানাভাবে তৈরি হয়। লগ্নক (aflix) যােগ করা তার একটি উপায়। শনির্মাণের লগগুলি সাধারণভাবে প্রত্যয় নামে পরিচিত- এগুলির তিনটি নাম দেওয়া যেতে পারে। আন্য প্রত্যয় (prefix), মধ্যপ্রত্যয় (infix), ও অন্ত্যপ্রত্যয় (suffix)। শব্দনির্মাণে ব্যবহৃত এই লাকগুলির চরিত্র, আর-যে ‘শব্দ’ বাক্যে ব্যবহৃত হয়, সেই ‘পদ’- এর নির্মাণের প্রক্রিয়া ভিন্ন।

বাক্যে ব্যবহৃত ‘পদ’ গুলির গায়ে যে লাক এসে জুড়ে যায় সেগুলিকে সস্কৃত ব্যাকরণে বলে ‘বিভক্তি’। কিন্তু ‘গ’ নির্মাণে যে সব সগ্রক ব্যবহূত হয় উপমহাদেশের ব্যাকরণ শাত্রে তার নাম ‘বিভক্তি (inflectional suffix)। অর্থাৎ ভারতীয় ব্যাকরণশাস্ত্রীরা প্রাচীনকালেই শনির্মাণ (derivation) এবং পদনির্মাণ (inflection)- অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে শব্দরূপ ও ধাতুরূপ- এ দুটি প্রক্রিয়ার ব্যাকরণগত পার্থক্য নির্দেশ করেছিলেন।

তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে শব্দনির্মাণ অভিধানকে পুষ্ট করে, তা মূলত ভাষার শব্দভাণ্ডার বা lexicon-কে বাড়িয়ে তােলে। কিন্তু পদনিৰ্মাণ ভাষার দৈনন্দিন বাক্যব্যবহারের অন্তর্গত, তা বাক্যনির্মিতি বা syntax-এর অংশ। অর্থাৎ রূপতত্ত্ব আর বাক্যনির্মিতির সংযােগস্থল হল পদনিৰ্মাণ। বাক্যে ব্যবহৃত হতে হলে সাধারণভাবে শব্দের সঙ্গে বিভক্তি জুড়ে দিতে হয়, তাতেই শব্দটি ‘পদ’ হয়ে ওঠে।

সুনীতিকুমারের কথায় প্রাতিপদিকের পরে বিভক্তি-যুক্ত হইয়া তবে বাক্যে প্রযুক্ত ‘পদ’ (inflected words) সৃষ্ট হয়’ (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৩৯ : ১২৪)। অবশ্য, বাংলার মতো স্বল্প বিভক্তির ভাষায় কোনাে বিভক্তি না জুড়লেও (পরিভাষা অনুযায়ী ‘শূন্য’ বিভক্তি জুড়লেও) শব্দটি পদ বলেই গণ্য হবে। বাক্যে ব্যবহৃত হওয়া মাত্র তার শব্দ-পরিচয় আচ্ছন্ন হয়, ‘পদ-পরিচয় প্রধান হয়ে ওঠে। পরপৃষ্ঠায় শব্দ ও পদের সাধারণ কিছু পার্থক্য দেখানাে হল।শব্দনির্মাণের রূপতত্ত্বে দেখানাে হয় কীভাবে আদ্যপ্ৰত্যয়-মধ্যপ্রত্যয়-অন্ত্যপ্রত্যয়ের যােগে কিবাে সমাস ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় নতুন শব্দ গড়ে ওঠে; আর পদনির্মাণের রূপতত্ত্বে দেখানাে হয় কীভাবে বিভক্তি যােগে পদ তৈরি হয়। পদনির্মাণের রূপতত্ত্বেরও দুটি প্রধান ভাগ। একটি শব্দরূপ বা কারক-প্রকরণ (case inflection, declension) যেখানে বাংলাভাষার ক্ষেত্রে সাধারণত বিশেষ্য ও সর্বনাম শব্দের নানা কারকের রূপ দেখানাে হয়। আর-একটি ধাতুরূপ বা ক্রিয়াকরণ (conjugation) যাতে নানা কালে (tense), প্রকারে (aspect), ভাবে (mood), এবং পক্ষে (person) ক্রিয়ার রূপ নির্মাণ করা হয়। ফলে বালা রূপতত্ত্ব অংশে আমাদের লক্ষ করতে হবে :

১. কীভাবে বালা জটিল বা সাধিত শব্দের নির্মাণ চলে; তাতে আদ্যপ্রত্যয় (উপসর্গ), কৃচিৎ মধ্যপ্রত্যয় এবং বহুলত অন্ত্যপ্রত্যয় যােগ ছাড়াও স্বরান্তর, সমাস, দ্বিত্ব কিংবা একাধিক মিলিত প্রক্রিয়ায় কীভাবে নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়;

২. ভাবে বিশেষ্য সর্বনাম ইত্যাদি শব্দ বিভক্তি ইত্যাদির যােগে কারকাশ্রিত হয়ে ‘পদ’ হয়ে দাঁড়ায়; এবং

৩. কীভাবে ক্রিয়াপদের নির্মাণ ঘটে।

এই তিনটির মধ্যে ১ যদি আমাদের অভিধানে শব্দের সখ্যো ও বৈচিত্র্য বাড়ায় তাে ২ আর ৩ আমাদের শব্দগুলিকে ‘পদ’-এ পরিণত করে বাক্যে ব্যবহারের যােগ্য করে তােলে।

ভাষার শব্দের দুই উৎস: বহিঙ্গা ও অন্তরঙ্গ

সমগ্রভাবে দেখলে একটি ভাষায় শব্দের দু-করে উস আছে একটি বহিরঙ্গা অর-একটি অন্তরঙ্গ। বহিরঙ্গ উৎসের শব্দ বাইরের কোনাে ভাষা থেকে আলে: অর্থতষটির অন্য ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক হয়, তার মানুষের দি অন্য কেটি ভাবা (প্রশাসনের ভবা, ধরে তব্য, শির ভাব, বণিভে বা জকের ভয) ব্যবহার কতে বাধ্য হন তাহলে সেই অন্য ভবর শব্দ বের হয় প্রবেশ করে।

এভাবেই বাংলা ভাষায় নানা ভাষার শব্দ গৃহীত হয়েছে। এগুলিকে স্বণশব্দ (loanwords) বলে। দুটি ভাষা সংযােগে যে দ্বিভাষিক প্রতিবেশের সৃষ্টি হয় তাতে কখনও একটি ভাষার আধিপত্য বেশি হয়, অন্যরকম। ওই অধিপত্যকরী রাজার বা ধর্মের ভাষা, সকৃতির ভাষা) থেকে দুর্বলতর ভাষায় ঋণশদের প্রবেশ বেশি ঘটে, উলটোটা তত ঘটে না। তাই যত ইংরেজি শব্দ বাংলায় এসেছে, তার তুলনায় ইংরেজিতে গৃহীত বাল্লা শব্দের সৰ্যো অকিঞ্চিৎ।

ব্যাকরণে শব্দের অন্তরঙ্গ

শব্দনির্মাণ ভাষার ব্যাণে শব্দতৈরির নিজৰ প্ৰঙ্কিাগুলির সাহায্যে ঘটে। এটি ভাষার শব্দের অন্তরঙ্গ উস। আগেই বলা হয়েছে, অন্যপ্ৰত্যয় বা উপসর্গ, মধ্যপ্রত্যয় বা বিদ্যুৎ, নানা ধরনের অন্তপ্রত্যয় কখনও একাবে, কখনও একাধিক উপাদান যৌথভাবে যুক্ত হয়ে একটি সাধিত শব্দ গঠন করে। আবার বন্তর, সমাস ইত্যাদিও নতুন শব্দনির্মাণের প্রক্রিয়া।

কিন্তু শব্দনির্মাণ প্রতিদিনের বা প্রতিমুহূর্তের ঘটনা নয়, যেখানে পদর্নির্মাণ প্রতিদিনের, এমনকি প্রতিমুহূর্তের ঘটনা। অর্থাৎ বাগব্যবহার হলেই পদনিৰ্মাণ ঘটে। পদনির্মাণের মূল ভিত্তি একদিকে যেমন প্রান্ত বা সিদ্ধ শব্দ, অন্যদিকে তেমনই সাধিত বা নির্মিত শব্দ যা আগেই নিহত হয়েছে ব্যান্তরে শনির্মাণ প্রক্রিয়া অনুসারে।

বাংলা শব্দের চরিত্র : প্রান্ত শব্দ, নির্মিত শব্দ

ভাষার সব শব্দ তার ব্যাণে নির্মাণ ব্রতে হয় না। যে-কোনাে তার শব্দভাণ্ডারে শিন্দ থাকে যা অবত বা অবিভাজ্য, অর্থাৎ যেগুলির নির্মাণের ইতিহাস আমাদের কাছে মুছে গেছে, ফলে সেগুলি বর্তমান রূপেই ভাষায় প্রা- যেমন হাত, পা, মাথা, ঘর, পথ, মানুষ, নদী, পেট, মুখ ইত্যাদি। এগুলিকে সাধারণভাবে বলা হয় প্রল (Simple) বা সিদ্ধ শব্দ।

আবার বহু শদের শরীরে তার নির্মাণের একটি ইতিহাস চিহ্নিত থাকে, যেমন ঢাকা-আই = ঢাকাইন্যক-হমি ন্যাকামি; ছুটে+পনা বুটেপনা; প্রতি+উৎপ-ত+মন-তিত্ব= প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব; ধনুঃ-ইং-কার ধনুষ্টংকার। এ শব্দগুলিকে বলে জটিল (complex) বা সাধিত শব্দ। এগুলিকে আরও ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে বােঝা যায় যে, সেই সব ক্ষুদ্র অংশগুলি জুড়ে এ শব্দগুলির প্রত্যেকটি গঠিত হয়েছে।

ভাষায় মূলত স্কুল বা সিল্ক এবং জটিল বা সাধিত- এই দু ধরনের শব্দ থাকে। সব সতি শব্দের নির্মাণের প্রক্সিটি স্পষ্ট নাও থাকতে পারে। বাংলা শব্দভাণ্ডারে যত সাধিত শব্দ আছে তার সবগুলির নির্মাণ বালা ভাবতে ঘটেনি।

ফেসব ভাষা থেকে আরাে শব্দ গ্রহণ করেছি সেসব ভাষাতেই তার নিজৰ ব্যাণে সেসব শব্দের অনেকগুলি নির্মিত হয়েছে। যেমন, সত ব্যাণের নিয়ম অনুসারে ব্যুৎপন্ন হয়েছে ব্যাঙ্কণ’, ‘কির্তব্যবিমূঢ়’, ‘ঐশ্বরক’ বা ‘পর্বতসানুদেশ’, ‘পাণ্ডব’ বা ‘গ্রামান্তর’ জাতীয় শব্দ। তার অনেকগুলির নির্মাণের প্রত্মাি বাতাবীর কাছে বহু বা সষ্ট নয়- যে নিরক্ষর বাঙালি এর কিছু কিছু শব্দ মুখে ব্যবহার করেন- ব্যাণ’, ‘নির’, ‘অলৌকিক’ ইত্যাদির ব্যুৎপত্তির বিবরণ তাঁর কাছে তাে নেই-ই।

শুধু সংসকৃৎ থেকে নেওয়া শব্দাবলি নয়, ফারসি ও আরবি থেকে আসা সাধিত শব্দের ব্যুৎপত্তি তার কাছে স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয় ইংরেজি বা পের্তুগিজ শব্দের ব্যুৎপত্তি। এমনকি বাংলা বেশির ভাগ সাধিত শব্দের ব্যুৎপত্তির ইতিহাসও বাঙালির কাছে স্পষ্ট নয়। তবে যে প্রত্যয়যােগ এবং পরিবর্তন-প্রক্রিয়াগুলি বাংলাভাষার নিজৰ প্রক্রিয়া, তাই ভাববিজ্ঞানী বা ব্যাণকারের কাছে এগুলি দেখানাের দায় আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *