বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

(PDF সহ) বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ: বাংলদেশ পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল এবং দশম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে মৎস্য সেক্টরের অবদান অনেক বেশি। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশকে মৎস্য চাষের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে ধরা হয়।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মাছ ও চিংড়ি খাত দ্বিতীয় বৃহত্তর রপ্তানি খাত হিসেবে স্বীকৃত। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ, কর্মসংস্থানে মৎস্য সেক্টর এক সম্ভাবনাময় সেক্টর হিসেবে আমাদের দেশে স্বীকৃত।

পুকুর, হাওড়, বাওড়, খাল, বিল, নদী, নালা ও সমুদ্র নিয়ে আমাদের বিশাল এক জলরাশি যার হৃদপিণ্ড হলো বঙ্গোপসাগর। স্বাধীনতার পরপরই স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালেই সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ঘোষণা করেন যে, “মাছ হবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ”।

সারা বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি দেশের পুকুর ও খালগুলোতে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে।

বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৫ গুণ। গত তিন দশকে মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অর্জন। দেশে উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশ এখন বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন মাছচাষীরা।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) সর্বশেষ সমীক্ষায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। এছাড়াও আগের দিনে গ্রামের মৎস্যচাষীরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রি করলেও এখন তারা তাদের মাছের দুই তৃতীয়াংশ ছোট বড় শহরে আড়ৎদারদের কাছে বিক্রি করছেন।

আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে মৎস্যখাতের অবদান ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যেটা মোট কৃষি আয়ের ২২ দশমিক ৬ শতাংশই আসে মৎস্য খাত থেকে। দেশের রফতানি আয়ের ৪ শতাংশের বেশি আসে মৎস্য সেক্টর থেকে।

এ ছাড়াও দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই মৎস্য সেক্টর থেকে। বাংলাদেশ সরকারের ভিশন ২০২১-এ দেশের মাছের উৎপাদন ৪৫ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১০ লক্ষ মেট্রিক টন বেশি।

তাছাড়াও দেশের প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য সেক্টরের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ। বছরে প্রায় ৬-৭ লক্ষ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে মৎস্য সেক্টরে।

বায়োফ্লক কি?

বর্তমান সময়কে মাথায় রেখে একদিকে পরিবেশের বিপর্যয় বা ক্লাইমেট চেঞ্জ অথবা গ্লোবাল ওয়ার্কিং যেটাই বলি না কেন, কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, খরচ কমানো এ সমস্ত বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন প্রযুক্তি কৃষিক্ষেত্রে যোগ হচ্ছে। এই পদ্ধতিগুলো কিছুক্ষেত্রে লাক্সমি প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করছে, আবার কখনো করছে না।

এই ধরণের একটি প্রযুক্তি হলো RAS প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষ। এর পরে আরো একটি উন্নত প্রযুক্তি এসেছে তার নাম হলো বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ। এটি RAS প্রযুক্তির চেয়ে অগ্রগামী। এটির (বায়োফ্লক) উৎপাদনশীলতা বেশি এবং উৎপাদন খরচ কম।

এখন আপাতদৃষ্টিতে দেখলে পুকুরে মাছ চাষ অনেক কমে যাবে। মাছ ফ্যাক্টরি এখন ঘরের মধ্যে, কারখানার মধ্যে, ঘরের ছাদে। সব জায়গায় এখন বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু হয়েছে এবং এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে চাষীরা অনেক লাভবান হওয়া শুরু করেছেন। তাছাড়া বর্তমানে দেশের বাইরে থেকে আনা প্রোবায়োটিক ব্যবহৃত হওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যায় অনেকটাই বেড়েছে।

এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে বিদ্যমান উপকারী অণুজীবগুলোর মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে প্রোবায়োটিক তৈরি করা গেলে উৎপাদন ব্যায় আরো অনেক কম হবে-নিশ্চিতভাবে এটা বলা যায়। এ জন্য আরও গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দরকার। এ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে দেশে মাছের উৎপাদন অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বাংলাদেশের মৎস্য শিল্পকে টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব করতে সম্ভাবনাময় দিগন্ত খুলে দিতে পারে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ। দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানী আয়ের সম্ভাবনাময় মৎস্যখাতটি নতুন আশার আলো হতে পারে বায়োফ্লক পদ্ধতির মাধ্যমে-যা বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সচেষ্ট ভূমিকা রাখবে।

বায়োফ্লক একটি Scientific Fish Culture System। বায়োফ্লক Technology বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। বায়োফ্লক হলো উপকারী ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ও শৈবালের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া পাতলা আস্তরণ। এই পদ্ধতি আবিস্কার করেন ইসরাইলের একজন মৎস্য বিজ্ঞানী।

বিজ্ঞানের ভাষায় বায়ো মানে জীবন। তাহলে আমরা বলতে পারি ফ্লকে জীবন আছে। অর্থাৎ ফ্লক হচ্ছে উপকারী জীবাণুদের বাসা বাধার ঘর। Biofloc Technology এর মুল কথা হলো অল্প জায়গাতে কিভাবে বেশি মাছ উৎপাদন করা যায়।

এটি একটি সাশ্রয়ী ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, যাতে মাছের ফিড বা বর্জ্য থেকে উৎপন্ন নাইট্রেট, নাইট্রাইট ও অ্যামোনিয়ার মত বিষাক্ত পর্দার্থগুলোকে প্রোটিন সেলে রূপান্তরিত করে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে মাছের খাবার খরচ ২৫-৩০% কম হয়।

এটাকে বলা হয় বর্জ্য পানি শোধন ব্যবস্থা। ফিস ট্যাংকে প্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) ছেড়ে তার সাথে প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেট উৎস্য (মোলাসিস) একত্রিত করে উচ্চ কোষের মাইক্রোবিয়াল প্রোটিন উৎপাদনের মাধ্যমে পানির গুণগত মান ভালো রাখা হয়। এতে ক্ষতিকারক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

Biofloc Technology এর মুলনীতি হলো বর্জ্য পুষ্টিকে পূর্ণ ব্যবহার যোগ্য করা। সর্বাধুনিক এই প্রযুক্তিতে একটি পুকুরের তুলনায় প্রায় ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি মাছ চাষ করা সম্ভব। প্রাচীন সনাতন পদ্ধতিতে যদি একটা পুকুরে ১০টি মারে পোনা চাষ করা যায়, বায়োফুক পদ্ধতিতে সেই পুকুরে ৪০টি মাছের পোনা চাষ করা সম্ভব।

উক্ত পদ্ধতিতে একটি ছোট হাউজে বা তারপলিন ট্যাংকে Biofloc Technology এর সঠিক প্রয়োগে দুই বিঘা পুকুরের সমান মাছ উৎপাদন করা যায়। Biofloc এর জীবন হলো প্রোবায়োটিক (Probiotic)। উক্ত প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে সফলতা আসবেই ইনশাআল্লাহ্।


🔅🔅 আরও পড়ুন: বারোমাস সবজি চাষ পদ্ধতি
🔅🔅 আরও পড়ুন: শাক সবজি চাষ পদ্ধতি
🔅🔅 আরও পড়ুন: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি পদ্ধতি
🔅🔅 আরও পড়ুন: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ছাগল পালন পদ্ধতি


বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বলতে কি বুঝায়?

বায়োফ্লক পদ্ধতি মাছ চাষের জন্য একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ মাছ চাষ প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি সাধারণত অল্প জায়গাতে অধিক মাছ উৎপাদনের একটি কৌশল।

বায়োফ্লক হলো প্রোটিন সমৃদ্ধ জৈব পদার্থ এবং অণুজীব যেমন- ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, ডায়াটম, অ্যালজি, ফেকাল পিলেট, জীবদেহের ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য মেরুদণ্ডহীন প্রাণি ইত্যাদির ম্যাক্রো-এগ্রিগ্রেট। এই প্রযুক্তি একটি এ্যাকোয়াকালচার সিস্টেম যা কার্যকরভাবে প্রচুর পুষ্টি উৎপাদনের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে।

উক্ত প্রযুক্তিতে খুব একটা পানি পরিবর্তন করতে হয় না বা একবারও পরিবর্তন করতে হয় না। এই পদ্ধতির পানিতে বিদ্যমান কার্বন ও নাইট্রোজেন এর সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করে পানির সমস্ত গুণাগুণ বৃদ্ধি ও ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে।

বায়োফ্লক প্রযুক্তি হলো এটা হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে, পানিতে উচ্চ কার্বন-নাইট্রোজেনের অনুপাত নিশ্চিত করার মাধ্যমে যা ক্ষতিকর অ্যামোনিয়াকে অণুজীব আমিষে রূপান্তরিত করে। এটি পরিবেশ বান্ধব বিকল্প পদ্ধতি যা ক্রমাগতভাবে পানিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোকে পুনঃআবর্তনের মাধ্যমে পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করে।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ এর উপকরণসমূহঃ

  • ফিস ট্যাংক।
  • পিএইচ (pH) মিটার ।
  • টিডিএস (TDS)/Salinity মিটার।
  • অ্যামোনিয়া কিট।
  • থার্মোমিটার।
  • ডিও (Do) মিটার।
  • সেটিংসহ এয়ারপাম্প মেশিন।
  • ইমহফ।
  • সোলার সিস্টেম/আইপিএস।
  • র-সল্ট (Raw Salt) (১০ কেজি)।
  • মোলাসিস /চিটাগুড় (১ কেজি)।
  • সিএসিও, (CaCO3) /পাথুরে চুন (২ কেজি)।
  • প্রোবায়োটিক (Probiotic) (১০০ গ্রাম)।
  • ফিড।
  • মাছের পোনা।

রাস (RAS) প্রযুক্তির সাথে বায়োফ্লকের পার্থক্য:

রাস প্রযুক্তিতে খরচ অনেক বেশি। অনেকের পুকুর নেই কিন্তু মাছ চাষের ইচ্ছে আছে। তারা রাস প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করার কথা ভাবতেই পারেন। তবে RAS প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করতে হলে বেশি টাকার দরকার।

যারা বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন তারা RAS প্রযুক্তিতে মাছ চাষে সহজে সফলতা পাবেন। অন্যদিকে বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে মাছ চাষের খরচ খুবই কম। যদি RAS প্রযুক্তির সাথে তুলনা করা হয় তাহলে রাস প্রযুক্তির চেয়ে বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে মাছ চাষে শতকরা ৮০ ভাগ খরচ কম লাগে।

RAS প্রযুক্তিতে মাছের খাবারের অবশিষ্টাংশ একটি পাইপের মাধ্যমে প্রথমে ম্যাকানিক্যাল ফিল্টারে নেয়া হয়। এরপর সেখান থেকে বায়োফিল্টারে নিয়ে আবার চাষ ট্যাংকে আনা হয়।

পক্ষান্তরে বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে কোন ফিল্টারের দরকার হয় না। বায়োফ্লক আসলে এক ধরণের উন্নতমানের ব্যাকটেরিয়া। এটা মাছের উচ্ছিষ্ট দুষিত অংশকে কনভার্টের মাধ্যমে প্রোটিন তৈরি করে দেয়। তবে বায়োফ্লক সিস্টেমে (প্রয়োজনে) ১৫ দিন পর পর ১০ ভাগ পানি বের করে দিতে হয়। RAS সিস্টেমে অনেক মেশিনারিজ প্রয়োজন হয়, কিন্তু বায়োফ্লকে শুধুমাত্র এয়ারেশান চালাতে হয়।

বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ একটি বিস্তৃত পদ্ধতি, যা একটি আর্টিকেলে লেখা সম্ভব নয়। তাই আমরা আপনাদের সুবিধার্তে পুরো পদ্ধতির পিডিএফ নিচে শেয়ার করলাম। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। 

আশাকরি আমাদের আজকের আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তক, গল্পের বই সহ যে কোন পিডিএফ ডাউনলোড করতে আমাদের সাথেই থাকুন। আমাদের যে কোন আপডেট মিস করতে না চাইলে ফেসবুক ও ইউটিউবে সাবক্রাইব করে আমাদেস দাথে কানেক্ট থাকতে পারেন। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।

বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ