বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়ােজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়ােজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ

মাননীয় সভাপতি, উপস্থিত সুধীমণ্ডলী, প্রিয় ছােটবন্ধুরা সকলকে জানাই নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

বর্ষবরণের এ আনন্দঘন দিনে আপনাদের মাঝে উপস্থিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দবােধ করছি এবং নিজেকে ধন্য মনে করছি। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি আনন্দঘন উল্লেখযােগ্য উৎসবমুখর দিন। আজকের এ পড়ন্ত বিকেলের মনােমুগ্ধকর প্রকৃতির সান্নিধ্যে আমরা আমাদের সুখী সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করছি। আপনারা আমার বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।

সুধী, আজ বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রির অবসান ঘটিয়ে নববৎসরের অরুণােদয়ের সূচনা ঘটল। আজ নতুনকে স্বাগত জানাবার দিন। সূর্য পরিক্রমণের একটি চক্র পূর্ণ করে পৃথিবী আবার নতুন করে যাত্রা। শুরু করেছে। সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে এই আবর্তনের ধারা অব্যাহত আছে। পৃথিবী চিরপুরাতন হয়েও আমাদের কাছে চিরনতুন। জরার অবসান ঘটিয়ে নবীনের আবির্ভাবকে সে যুগ যুগ ধরে স্বাগত জানিয়ে আসছে। মানুষের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল সুখ-দুঃখে গড়া একটি বছর। কিন্তু তার জন্য শােক নয়— যা এলাে, যা অনাগত সম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল, তাকে আবাহন করার দিন আজ।

সুধীবৃন্দ, আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার জন্য। নববর্ষ বাঙালি জাতির কাছে একটি ট্রেভিশন, একটি ঐতিহ্য। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের নতুনের মাহাত্ম। রূপকথার জিয়ন কাঠির মতাে এ দিনটির মর্মস্পর্শে দূরীভূত হয় পুরােনাে দিনের সকল জরাজীর্ণতা। ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে উঠে বাঙালির ক্লান্ত-শ্রান্ত জীবন। বাঙালির কাছে বাংলা নববর্ষ তাই প্রাণের খােরাক।

সুধী, আপনারা জেনে থাকবেন যে, প্রতিবছর এ দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় নতুনের বার্তা- আশার আলাে নিয়ে। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই দিনটি হয়ে উঠে উৎসবমুখর। আমাদের আশা, হে বৈশাখ, তাপসনিশ্বাস বাতাসে পুরাতন বৎসরের সঞ্চিত আবর্জনার স্তুপকে উড়িয়ে দাও। বিলীয়মান অতীত নতুনের অভিষেকে বিচ্ছেদের অশ্রুবাষ্প নিয়ে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। নিত্য চলার মধ্যে যে নবীনতা আছে নববর্ষ তারই মন্ত্রে আমাদের দীক্ষিত করে তুলুক। নববর্ষকে আহ্বানের মধ্যে এই নিত্যচলার বাণীটিই আমাদের কণ্ঠে পুনর্বার উচ্চারিত হােক।

প্রিয় সুধীসমাজ, আপনারা লক্ষ করে থাকবেন যে, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত। কৃষিপ্রধান এদেশের মানুষ নববর্ষে তাদের কৃষি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেতে ওঠে। ব্যবসায় বাণিজ্যে বাংলা নববর্ষ আবহমান কাল ধরে প্রাণবন্ত ভূমিকা রেখে আসছে। ব্যবসায়ীরা এ দিনে হালখাতার আয়ােজন করে। হালখাতা’ অনুষ্ঠানে ক্রেতা-বিক্রেতার মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয় মিষ্টিমুখের মাধ্যমে। সারা বছরের বাকি-বকেয়া পরিশােধ করে দোকানে নতুন বছরের হিসাব খুলে।

সুধীবৃন্দ, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতি তাদের সংস্কৃতির বিলীয়মান ধারাকে উজ্জীবিত করে এবং এদেশের লােকজ ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ইতিহাসকে তুলে ধরে। তাইতাে বাঙালি জাতি জীবনের সকল জীর্ণ, পুরােনাে জঞ্জালকে ছুড়ে ফেলে নতুন বছরকে আহ্বান করে নতুন সাজে। বাঙালি জাতি তার শত বছরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে স্মরণের জন্য এ দিনটিকে বরণ করে। তাই এর আগমনে আমাদের মন সাড়া দেয়, চঞ্চল হয়, নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেয়। এদিন আমরা প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে, নতুন নতুন পােশাক-পরিচ্ছদ পরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাত ও বৈশাখী খাবারে ও মেলায় মেতে ওঠি। রমনার বটের তলায় জড়াে হয়ে গান গাই, হাততালি দিই। সবকিছু মিলে দেশটা যেন হয়ে ওঠে উৎসবে আনন্দে পরিপূর্ণ।

প্রিয় সুধীবৃন্দ, আমাদের জীবনেতিহাসের সার্বিক পটভূমিতে এ দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের জাতীয় চেতনা অর্থাৎ বাঙালি সত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুজাতি-গােষ্ঠী অধ্যুষিত একটি শান্তির দেশ। এখানে প্রতিটি সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব। এগুলাের অধিকাংশই নির্দিষ্ট গােষ্ঠীর আনন্দ অনুষঙ্গ বলে স্বীকৃত, কিন্তু পহেলা বৈশাখই একমাত্র উৎসব যা কোনাে ধর্মের বা গােষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গােটা জাতির তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অখণ্ড বাঙালি জাতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গে দেশের সকল মানুষ একই সময় অভিন্ন আনন্দ-অনুভূতিতে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মনে করে এক অখন্ড সত্তা রূপে। ফলে জাতিগত সংহতি ও ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে দূরত্ব কমে আসে। নববর্ষ পরিণত হয় একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠানে।

সুধীমণ্ডলী, নববর্ষ সমগ্র মানুষের কাছে নবজীবনের দ্বার উন্মােচিত করে দিক। নতুন বছর যেন মুষ্টিমেয় ধনীর ভােগবিলাসের সঙ্কীর্ণ উল্লাসে পরিণত না হয়; দারিদ্র্য লাঞ্ছিত পীড়িত মানুষের নিষ্ফল বিলাপে যেন পৃথিবী বিষন্ন না হয়ে ওঠে; যুদ্ধদীর্ণ বিশ্বের পাশবশক্তির তাণ্ডব যেন শান্তির শুভশক্তির কাছে পরাভূত হয়। আসুন পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে আমরা আমাদের মধ্যকার সকল বিভেদ ও দ্বিধা দূর করতে সচেষ্ট হই। আমরা জাগ্রত হই অখণ্ড জাতীয় চেতনায়। আমরা ঋদ্ধ হই আগামীর গর্বিত প্রেরণায়। নববর্ষে নতুন সূর্যালােককে সাক্ষী রেখে আমরা যেন আগামী দিনের সভাবনাকে সার্থকতামণ্ডিত করে তুলতে পারি। নতুন বছর আমাদের সবার জীবনে সুখ-সভার বয়ে আনুক এই প্রত্যাশায় সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। আজ নববর্ষের এই শুভক্ষণে, আসুন, কবিকণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি,

“যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবাে জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযােগ্য করে যাব আমি—/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

১ বৈশাখ বাঙালি জাতির জীবনে তাই ফিরে আসুক বার বার নতুন করে-নতুনবেশে-শতরূপে-শতবার। সবাইকে ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *