কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে চিত্রিত সমাজচিত্র

কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে চিত্রিত সমাজচিত্র ও কাহিনি-বিশ্লেষণ

কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে চিত্রিত সমাজচিত্র ও কাহিনি-বিশ্লেষণ: ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, শস্য-শ্যামলা সবুজ বাংলার কোনো একটি গ্রামের এক কিশোর বুধা। এক চাচি আর চাচাতো ভাই-বোন ছাড়া তিন কুলে আপনজন বলতে তার আজ আর কেউ নেই। তবে একদিন পরিবার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই ছিল। এক রাতে কলেরায় সবাই মারা গেল। ভাগ্যক্রমে সে বেঁচে যায়।

চাচির বাড়িতে প্রথমে সে আশ্রয় নেয়। চাচি দারিদ্র্যের কথা তুললে বুধা সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকেই সে একা। ঔপন্যাসিক এর সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- “রাত পোহালে দিনের আলো, সূয্যি ডুবলে আঁধার। ওর কাছে দুটোই সমান। হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে যে কোথায় যায় সে হিসেব রাখে না।

ওর কাছে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সব সমান। মনে করে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ওর জন্য রাস্তা খোলা।” পুরো গ্রাম আর হাটবাজার হয়ে উঠল বুধার বিচরণক্ষেত্র। চেনা-জানা সব মানুষ হয়ে উঠল তার আপনজন। একদিন ঐ গ্রামে মিলিটারি ঢুকে পড়ল। পুড়িয়ে দিল বাজারের দোকানপাট। বিস্মিত বুধা, কেন তারা এমন করল?

কী এমন অপরাধ করেছে এ দেশের মানুষ? ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো সে। ভাবল, এর প্রতিকার হওয়া দরকার। এ অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধ কী তা সে না বুঝলেও মুক্তিযুদ্ধ যে শুরু হয়ে গেছে, এটা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে সহজেই উপলব্ধি করে যে, ঐ মিলিটারি সবাই বিদেশি । তারা এদেশের মানুষ নয়।

এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি। শুধু এরা নয়, যারা এদের সহায়তা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হবে। হানাদারদের আক্রমণে জান ও মাল বাঁচাতে নোলক বুয়া, হরিকাকু আর রানিদের মতো শত শত মানুষ গ্রাম ত্যাগ করে অজানার পথে পা বাড়ায় ।

বুধা তাদের মতো গ্রাম ছেড়ে যেতে চায় না। সে ছোট হলেও ভিতু নয়। ওদের বিরুদ্ধে সে লড়াই করবে। ও ঠিকই বুঝে যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব বিদেশির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলেছেন। . বুধা মাঝেমধ্যেই কাকতাড়ুয়া সেজে যেমন মজা করে, তেমনই কাকতাড়ুয়ার দৃষ্টিতে সে পুরো গ্রামটাকে, গ্রামের মানুষকেও পর্যবেক্ষণ করে।

সে দেখে পুরো গ্রাম যেন দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে আহাদ মুন্সির মতো হানাদারদের সহযোগীর দলে, অন্যদিকে মিঠু, আলির মতো প্রতিশোধস্পৃহায় ছটফট করতে থাকা স্বাধীনতাকামীদের দলে। বুধা নিজের ভেতরে এক অনির্বচনীয় জোশ ও তাড়না অনুভব করে। আকস্মিকভাবে ও চেঁচিয়ে ওঠে ‘যুদ্ধ, যুদ্ধ। স্বাধীনতা, স্বাধীনতা!!’ মুক্তিযোদ্ধা আলি ও মিঠু রাতের আঁধারে গ্রামে এলো। বুঝাকে বলল স্কুলের মিলিটারি ক্যাম্পটা উড়িয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল বুধা।

প্রথমে পুড়িয়ে দিল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ মুন্সির বাড়ি । তারপর রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল। বাপ-মা ও চার ভাই-বোন হারানো পাগল স্বভাবের কিশোর বলে কেউ তাকে তেমন একটা সন্দেহ করল না। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা শিল্পী শাহাবুদ্দিন তাকে ‘মাইন পুঁতে ক্যাম্পটা উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেন।

বাঙ্কার খোঁড়ার সময় · কৌশলে সে-তার ভেতর মাইন পুঁতে চলে এলো নদীর ধারে। এখানেই অপেক্ষা করছিলেন শাহাবুদ্দিন এবং তার সহযোদ্ধারা। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কারে ঢুকতেই মাইনের বিস্ফোরণে পুরো ক্যাম্পটা উড়ে গেল। নদীতে নৌকায় বসে শাহাবুদ্দিন, বুধা শুনতে পেল সেই শব্দ। সফল হলো তাদের অভিযান।