ভারত অভিজানে সুলতান মাহমুদের সাফল্যের কারণ এবং এর ফলাফল কি?

সুলতান মাহমুদের সাফল্যের কারণ (Causes of the Success of Sultan Mahmud)

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ইসলামের ইতিহাসে এক বিসায়কর ঘটনা। তিনি ছিলেন সুদক্ষ সেনানায়ক ও সাহসী বিজেতা। সমসাময়িক কোনাে নৃপতি বা বিজেতাই তার সমকক্ষ ছিলেন না। তিনি তার সতেরাে বার ভারত অভিযানের প্রায় প্রতিটিতেই জয় লাভ করেন। তার এ সাফল্যের পেছনে বেশকিছু কারণ ছিল ।

প্রথমত: গজনি এবং ভারতের তদানীন্তন বাস্তব পরিস্থিতি সুলতান মাহমুদের সাফল্যের অনুকূলে ছিল । ঈশ্বরী প্রসাদের মতে “সামানি বংশের পতন, হিন্দু রাজাদের মধ্যে চিরস্থায়ী বিবাদ ও মতবিরােধ, অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে জোট গঠনে তাদের ব্যর্থতা, পারস্যের ক্ষমতা হ্রাস, তুর্কিদের অসীম উদ্দীপনা প্রভৃতি উপাদান একযােগে মাহমুদের সাফল্যের অনুকূলে কাজ করেছে, তার প্রতিটি অভিযানকে সার্থক করেছে এবং তার ধর্মের জন্য এনে দিয়েছে অসামান্য বিজয়।”

দ্বিতীয়ত: এস. লেনপুলের (Stanley Lanepoole) মতে, “রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভক্তি এবং প্রাকৃতিক কারণে স্বভাবত দুর্বল ভারতীয়রা মাহমুদের ঐক্যবদ্ধ দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভে অসমর্থ হয়ে পড়ে। বস্তুত সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও অনৈক্য ও অরাজকতার কারণে হিন্দু রাজন্যবর্গ তুর্কি বাহিনীর মােকাবিলায় ব্যর্থ হয় ।

তৃতীয়ত: সুলতান মাহমুদের মােকাবিলায় ভারতীয়রা কনফেডারেসি’ গঠন করে সত্য; তবে জাতিভেদ, বর্ণবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও পারস্পরিক কোন্দলের কারণে কনফেডারেসি আত্মাবিহীন ভূত’ (Soulless ghost)-এ পরিণত হয় ।

চতুর্থত: সুলতান মাহমুদ নিজে একজন অসাধারণ সমরকুশলী সেনানায়ক ছিলেন। প্রাবন্ধিক ও লেখক এস. আর শর্মা (Sita Ram Sharma) বলেন, “মাহমুদ ছিলেন দক্ষ সৈনিক, তার হৃদয়ে কখনও ভয় উদ্রেক হতাে না।” (Mahmud was a seasoned soldier. Fear did not find any place in his heart.) অপূর্ব রণচাতুর্য, কূটনীতি এবং সেনাবাহিনী সংগঠন ও সৈন্য পরিচালনায় দক্ষতা ভারতীয় অভিযানে তার সাফল্যের অন্যতম কারণ।

পঞ্চমত: যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় নেতৃত্ব ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল। তাদের যুদ্ধকৌশল ছিল পুরােনাে ও সনাতন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীও ছিল বিশৃঙ্খল । অন্যদিকে সুলতান মাহমুদের সেনাবাহিনী ছিল তুর্কি, আফগান, পারসিক ও ভারতীয়দের সমন্বয়ে গঠিত সুশৃঙ্খল, সুসজ্জিত, রণনিপুণ ও অমিততেজি। তাদের যুদ্ধকৌশল ছিল ভারতীয়দের তুলনায় অনেক উন্নত। তাদের অশ্বারােহী বাহিনীর মােকাবিলায় ভারতীয়দের পদাতিক ও হস্তিবাহিনী ছিল অনেক পশ্চাৎপদ। এছাড়াও জেহাদের প্রেরণা ছাড়াও যুদ্ধে জয় লাভ শেষে গনিমাত (booty) প্রাপ্তির প্রত্যাশা মুসলিম বাহিনীকে অজেয় করে তুলেছিল। অধ্যাপক এম. হাবিব বলেন, “সুলতানের অসামান্য মেধা এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ফলে এটি (সামরিক বাহিনী) দ্বিধাবিভক্ত শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে অপরাজেয় এবং দুর্ধর্ষ শক্তিতে পরিণত হয়।”

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল (Results of Sultan Mahmud’s Expeditions to India)

ভারত অভিযানে অসামান্য সাফল্য সত্বেও পাঞ্জাব ছাড়া আর কোনাে অঞ্চলকে সুলতান মাহমুদ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। তাই কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন তার ভারত অভিযানের বিশেষ কোনাে রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল। অবশ্য নিরপেক্ষ বিচারে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী বলে প্রতীয়মান হয়।

রাজনৈতিক ফলাফল

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থবহ ও ফলপ্রসূ ছিল। তার ভারত অভিযানের কোনাে স্থায়ী রাজনৈতিক প্রভাব নেই এ ধারণা করা ভুল হবে। কেননা-

প্রথমত: এ কথা সত্য যে, তিনি ভারতের বিজিত অঞ্চলকে তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি এবং এ অভিপ্রায় তার মধ্যে ছিলও না। তবে পাঞ্জাবকে তার সাম্রাজ্যভুক্তকরণ সীমিতভাবে হলেও তাকে ভারত নৃপতির মর্যাদা দিয়েছে। ভি, এ, স্মিথ (Vincent Arthur Smith) বলেন, “এ সংযােজনই মাহমুদের ভারতবর্ষের নৃপতি হওয়ার একমাত্র দাবি। পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে এ পাঞ্জাবেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত: সুলতান মাহমুদের পাঞ্জাব অধিকার পরবর্তী সময়ে ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল, অধ্যাপক আর, সি, মজুমদার (Ramesh Chandra Majumder) বলেন, “গজনভিদের পাঞ্জাৰ অধিকার ছিল ভারতবর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশের চাবিকাঠিস্বরূপ।”

তৃতীয়ত: এ অভিযানে ভারতের হিন্দু সামরিক শক্তির দুর্বলতা, রাজন্যবর্গের অনৈক্য প্রকাশ হয়ে পড়ে । ফলে তুকি পরাক্রমের মুখে ভারতীয়দের নৈতিক মনােবল ভেঙে যায়, যা পরবর্তী মুসলিম বিজয়কে সহজতর করে।

অর্থনৈতিক ফলাফল

সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের ফলে ভারতে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। উত্তর ভারতীয় রাজ্যসমূহ বড় রকমের আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভারত থেকে লুণ্ঠিত বিপুল ধনৈশ্বর্য দিয়ে মাহমুদ গজনির উন্নতি ও সমৃদ্ধি করেন। ফলে গজনি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়।

ধর্মীয় ফলাফল

পরােক্ষভাবে হলেও সুলতান মাহমুদের অভিযানসমূহ ভারতবর্ষে ইসলাম প্রসারের পথ উন্মুক্ত করেছিল। ডব্লিউ হেগ বলেন, “তিনিই প্রথম যিনি ভারতের অনেক অভ্যন্তরে ইসলামের বিজয় পতাকা বহন করে নিয়ে যান। তাছাড়া এসব বিজয়াভিযানের সময় আগত পির-দরবেশ ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল বলে অধ্যাপক এস, এম, জাফর উল্লেখ করেছেন।

সাংস্কৃতিক ফলাফল

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের সাংস্কৃতিক ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার অভিযানসমূহে ভারতীয় অনেক মন্দির ও শহর ধ্বংস হয়। ভারতীয় শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবে এর কিছু ইতিবাচক সাংস্কৃতিক প্রভাবও লক্ষণীয়। এসব অভিযানের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির আদান-প্রদানের সুযােগ ঘটে। ফলে উভয়ের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে এক নবঅধ্যায়ের সূচনা হয় এবং ইন্দো-মুসলিম কৃষ্টি বিকাশ লাভ করে। ভারত থেকে সংগৃহীত ধন-সম্পদ দিয়ে মাহমুদ গজনির সার্বিক উন্নয়ন ছাড়াও সেখানে শিল্প- সাহিত্যের বিকাশ ঘটান । গজনিকে তিনি মধ্যযুগের একটি শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *