সুলতান বলবনের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

দিল্লি সালতানাত সুদৃঢ়ীকরণে সুলতান বলবনের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

Steps taken by Sultan Balban to Consolidate Delhi Sultanate

রাজতন্ত্র সুদৃঢ়ীকরণের মধ্য দিয়ে নিজেকে সুলতান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বলবন সালতানাতের স্থায়িত্ব বিধানে মনােযােগী হন। এক্ষেত্রে তিনি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হলাে:

সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন: মধ্যযুগীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রধান ভিত্তি হলাে সামরিক বাহিনী। সুশৃঙ্খল সালতানাত প্রতিষ্ঠায় অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও বহিঃশক্তির আক্রমণ প্রতিহতকরণে সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলবন এর পুনর্গঠনে পদক্ষেপ নেন। জায়গির প্রথা বিলুপ্ত করে সেনাবাহিনীকে নগদ অর্থে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করেন। সামরিক কর্তব্য পালনে সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ােগ দিয়ে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন। সুলতান বলবন তার সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের দায়িত্ব তার আস্থাভাজন ‘দিউয়ান-ই-আর’ (সমরমন্ত্রী) ইমাদ-উল-মূলকের ওপর ন্যস্ত করেন। এ. বি. এম, হবিবুল্লাহ বলেন, “তার (ইমাদ-উল-মূলক) সততা ও সৈনিক ভর্তির খুঁটিনাটি বিষয়ে সযত্ন দৃষ্টি এবং সৈনিকদের বেতন, যুদ্ধোপকরণ সংগ্রহসহ সব বিষয়ে মনােযােগের ফলে সেনাবাহিনীর শক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।”

চল্লিশচক্র দমন: সুলতান ইলতুৎমিশের রাজত্বকালেই তুর্কি অভিজাতরা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হন। এ অভিজাতদের একটি চক্র বন্দেগান-ই- চেহেলেগান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ইলতুৎমিশের দুর্বল উত্তরাধিকারীদের যুগে রাজ্যপ্রশাসন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এরা সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। বলবন নিজেও এ চক্রের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তাই তিনি এদের অশুভ প্রভাববলয় সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সুলতান বলবন উপলব্ধি করেন যে, সালতানাতের মৰ্যদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নিজের ক্ষমতা ও নিরাপত্তা সুসংহত করার জন্য তুর্কি অভিজাত চল্লিশ চক্রের ক্ষমতা নাশ করা প্রয়ােজন। এ লক্ষ্যে তিনি নিম্নপদস্থ তুর্কিদের উচ্চ পদে নিয়ােগ করে অভিজাত চল্লিশ চক্রের সমপর্যায়ভুক্ত করেন। সামান্য অপরাধে তাদের কঠোর শাস্তি দিয়ে জনসম্মুখে হেয় করেন । তাছাড়া বিশেষ সুযােগ-সুবিধা এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে জায়গির বাতিলের মাধ্যমে তাদের দুর্বল ও ক্ষমতাহীন করে সুলতানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনা হয়।

সুলতান বলবনের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

মেওয়াটি দস্যুদের দমন: বলবনের রাজত্বকালে মেওয়াটি পার্বত্য অধিবাসী দস্যুদের চরম উৎপাত, লুটতরাজ ও নির্দয় হত্যাযজ্ঞে দিল্লি ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলােতে জনজীবনে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসে। ঈশ্বরী প্রসাদের বর্ণনা মতে, তাদের ঔদ্ধত্য এতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, আসর নামাজের পর রাজধানী দিল্লির পশ্চিম ফটক বন্ধ করে দিতে হতাে। বলবন জনগণের জানমাল ও দিল্লির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মেওয়াটি দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন দস্যুদের অভয়ারণ্য দিল্লির আশপাশের বড় বড় জগলগুলাে কেটে পরিষ্কার করা হয়। দিল্লির চতুর্পাশে সুরক্ষিত সামরিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। ভবিষ্যতে তাদের আক্রমণ রােধের জন্য প্রয়ােজনীয় স্থানে পুলিশ চৌকি স্থাপন করা হয়।

দোয়াবের বিদ্রোহ দমন: বলবনের সময় গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে দুর্ধর্ষ হিন্দুদের বেআইনি তৎপরতায় সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে । এদের উৎপাতে পণ্য সম্ভার নিয়ে বণিক-ব্যবসায়ীদের চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হয়। এ অবস্থায় সুলতান এসব অরাজকতা নির্মূলে উদ্যোগী হন। বিদ্রোহীদের প্রধান আস্তানা কাম্পিল, পাতিয়ালা এবং ভােজপুর করায়ত্ত করে লুটকারীদের নিশ্চিহ্ন করা হয়। ফলে দস্যদের আস্তানা আফগান সৈনিক ও সেনানায়কদের আস্তানায় রূপান্তরিত করা হয় ।

রােহিলাখণ্ডের বিদ্রোহ দমন: বলবন যখন দোয়াবের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত তখন রােহিলখিণ্ডেও দাঙ্গা শুরু হয় কতেহার হিন্দুপ্রধানদের এ বিদ্রোহে সুলতান অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। সুলতান রাজকীয় বাহিনীকে বিদ্রোহীদের সমূলে নির্মূল করার জন্য আদেশ দিলে অত্যন্ত নির্মমভাবে তাদের দমন করা হয়। বিদ্রোহীরা গণহত্যার শিকার হয়। গােটা অলেকে ধ্বংসস্কৃপে পরিণত করে রাজকীয় বাহিনী বিপুল পরিমাণ সম্পদ হস্তগত করে।

জাঠ উপজাতিদের দমন: জাঠ পার্বত্য উপজাতি গােষ্ঠী বিদ্রোহী হলে সুলতান তাদেরও কঠোর হস্তে দমন করেন তাদের দুর্গ আক্রমণ এবং গােটা অঞল ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে অরাজকতার অবসান করা হয়।

গােয়েন্দা ব্যবস্থা প্রবর্তন: ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, সুদক্ষ গােয়েন্দা ব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রের স্বাভাবিক এবং অনিবার্য সহযােগী।’ এ সত্য উপলব্ধি করে বলবন একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তােলেন। এ খাতে তিনি যথেষ্ট সময় ও প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতিদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত গােয়েন্দারা রাজধানীর পন্য আমাত্য ও অভিজাতবর্গ, প্রদেশপাল এবং উচ্চ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এমনকি সুলতানের পুত্রদের দৈনন্দিন কার্যক্রম ও গতিবিধি সম্পর্কে সুলতানকে জানাতেন। সফল গােয়েন্দা তৎপরতার ফলে বিদ্রোহ ও অপরাধ তৎপরতার সংখ্যা ও মাত্রা হ্রাস পায়।

অভ্যন্তরীণ প্রশাসন পুনর্গঠন: শুধু সামরিক শক্তি দ্বারা একটি রাজ্য পরিচালনা সম্ভব নয়। এ কারণে বলন তার অভ্যন্তরীণ প্রশাসন পুনর্গঠন করেন। ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “এ প্রশাসনের ভিত্তি ছিল দক্ষতা এবং প্রকৃতি হিল আধা বেসামরিক ও আধাসামরিক।” সুলতান স্বয়ং ছিলেন প্রশাসনের সকল কর্তৃত্বের উৎস। শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন এবং তা কার্যকর করা ছিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে তার পুত্রদের প্রদেশপাল নিয়ােগ করেন। তবে তাদেরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতাে।

বিচারব্যবস্থা: সুলতান গিয়াসউদ্দিন ন্যায়বিচারক ছিলেন। বিচার কাজে তিনি নিকটাত্মীয়দের কোনাে পক্ষপাতিত্ব করতেন না। তিনি নিরপেক্ষভাবে বিবাদির ক্ষোভ প্রশমন করতেন। ন্যায়বিচারের ব্যাপারে সুলতানের কঠোরতার ফলে কেউ তার ভৃত্য বা ক্রীতদাসের প্রতিও অন্যায় করার সাহস করত না। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে সুলতান বলবন দিল্লি সালতানাতকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *