তারাবীর নামাজের নিয়ম

তারাবীর নামাজের নিয়ম, ফজিলাত ও গুরুত্ব

শুরু হয়েছে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস রমজান। এই মাসের প্রধান দুটি আমল হলো সিয়াম ও কিয়াম। সিয়াম বা রোজা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, দাম্পত্য মিলন ও রোজা ভঙ্গ হওয়ার সকল বিষয় থেকে দূরে থাকা। আর কিয়াম হলো রাতে তারাবির নামাজ।

তারাবীহ কী?

রমাদানে এশা’র সালাত আদায়ের পরই যে কিয়ামুল লাইল (রাতের ইবাদাত) আদায় করা হয়, সেটিই তারাবীহ। কেননা, সাহাবীগণ এই সালাত আদায়ের সময় প্রতি চার রাকাত পর পর বিশ্রাম নিতেন। এর কারণ – তাদের সালাত ছিল দীর্ঘ সময়ের৷ তারাবীহ হলো সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (যে কাজ রাসূল (স) অবশ্যই করতেন ; এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।)

তারাবী নামাজের ইতিহাস

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মোবারকের আজ চতুর্থ দিন। রমজান মাসে প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার বর্জনের মাধ্যমে সিয়াম পালন করা হয়। এটিই এ মাসের প্রধান ও প্রথম পালনীয়। তবে সিয়াম পালনের পাশাপাশি আরেকটি ইবাদত অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে এ মাসের সঙ্গে।

অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে মুমিন বান্দারা এতে মশগুল থাকেন। পবিত্র রমজানের সঙ্গে এটির ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক। সালাতুত তারাবি নামে পরিচিত ইবাদতটির কারণে পবিত্র মাসের গাম্ভীর্য ও প্রেম বেড়ে যায় অনেক গুণ। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা দিনে রোজা রেখে ও রাতে এশার সালাতের পর দীর্ঘণ তারাবিহের নামাজের কষ্ট আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন।

সারা দিনের ক্লান্তির উপেক্ষা করে দীর্ঘ সময়ের এই সালাতে নিমগ্ন থাকা আল্লাহ তায়ালার প্রতি একান্ত আত্মনিবেদন ও তার পাক কালামের প্রতি তাদের উৎসাহ ও অনুরাগের প্রমাণ। তা ছাড়া প্রতিদিন এশার নামাজের পর মসজিদে মসজিদে যখন আল্লাহর পবিত্র বাণীর তিলাওয়াত চলতে থাকে, তখন পুরো দেশজুড়ে বিরাজ করে অনুপম আবহ। কুরআন মাজিদের তিলাওয়াতে বেহেশতি সুর মূর্ছনায় মুগ্ধ হন মুসল্লিরা।

জামায়াতের সঙ্গে সালাতুত তারাবিহের বর্তমান নিয়মটি চালু হয়েছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক রা. সময় থেকে। এর আগে অর্থাৎ রাসূলে পাক সা. ও হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এর সময়ে এমনকি হজরত ওমর ফারুকের খেলাফতকালের প্রথম ভাগেও মুসলমানেরা রমজানের রাতগুলোতে এশার নামাজের পর অতিরিক্ত যে সালাত আদায় করতেন, তা একাকী করতেন।

এ জন্য জামাত বা সম্মিলিত কিছুর আয়োজন ছিল না। তবে নবী করিম সা. রমজানে কিয়ামুল লাইল বা রাত জেগে ইবাদত-বন্দিগির বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং এ জন্য অশেষ পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, রাসূল সা. রমজানের রাতগুলোতে ইবাদত করার জন্য আমাদের উৎসাহ দিতেন।

কিন্তু জোরালো আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি রমজানে ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে কিয়াম করবে, তার ইতঃপূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাতের ইবাদত করার নিয়ম চালু ছিল তার জীবদ্দশায়। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর সময়ে একই নিয়ম চালু ছিল। এটিই বহাল ছিল হজরত ওমর ফারুক রা. এর খেলাফতকালের প্রথম ভাগেও। (বুখারি শরিফ)

হজরত ওমর ফারুক রা. এর সময়ে জামাতের সঙ্গে সালাতুত তারাবিহ চালু হওয়া সম্পর্কে একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন আবদুর রহমান ইবনে সায়েব ইবনে আবদুল কারি নামে এক তাবেয়ি। তিনি বলেন, রমজানের এক রাতে হজরত ওমর ফারুক রা:-এর সঙ্গে আমি মসজিদে নববীতে গেলাম। দেখলাম লোকেরা বিক্ষিপ্তভাবে ইবাদত করছে।

কেউ একাকী, আবার কারো সঙ্গে কয়েকজন যোগ দিয়ে নফল নামাজ আদায় করছেন। হজরত ওমর রা. বললেন, এদের সবাইকে একজন তিলাওয়াতকারীর পেছনে একত্র করে দিলে ভালো হতো। পরে হজরত উবাই ইবনে কা’বকে ইমাম নিযুক্ত করা হয়। কেননা হজরত উবাই রা. ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে শুদ্ধ ও মধুর কণ্ঠে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াতকারী। এরপর এক দিন আবারো বের হলেন হজরত ওমর রা.। বর্ণনাকারী আবদুর রহমান বলেন, হজরত উবাই রা.-এর ইমামতিতে তখন এই নামাজ চলছে।

পরিবেশটি দেখে হজরত ওমর মুগ্ধ হলেন এবং বললেন, চমৎকার আবিষ্কার এটি। তবে তিনি একই সঙ্গে একটি মন্তব্যও করলেন। বললেন, তোমাদের ঘুমের সময়টা তোমাদের জেগে থাকার সময় থেকে ভালো অর্থাৎ হজরত ওমর রা.-এর ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল লোকেরা প্রথম রাতে এশার নামাজের পরই ঘুমিয়ে পড়ুক আর মধ্য রাতের পর ইবাদতে মশগুল হোক। কিন্তু তা সাধারণভাবে কষ্টের কাজ।

লোকেরা এমনটি অভ্যাস করতে পারবে বলে তিনি মনে করলেন না। বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরামের যুগেই যখন ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটছিল, তখন নতুন মুসলমানদের পক্ষে এমন কষ্ট সহ্য করা সহজ হবে না বলে মনে করলেন ইসলামের খলিফা। তা ছাড়া একাকী দীর্ঘক্ষণ সালাত আদায় করার চেয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করা কম কষ্টকর।

তেমনি কুরআন মাজিদের বড় বড় সূরা সবার মুখস্থ থাকে না। এসব দিক বিবেচনা করে সবার জন্য যা সহজ হয় তারই ব্যবস্থা করলেন তিনি। এমন একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় যে, হজরত আলী রা. এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন হজরত ওমর রা:-এর। এভাবে যে নামাজ চালু হয় তা তারাবিহ নামে আখ্যায়িত হওয়ার কারণ মাঝখানের বিরতিগুলো।

২০ রাকাত নামাজ আদায় করতে গিয়ে প্রতি চার রাকাতের পর কিছুণ বিশ্রাম নেয়ার রীতি ছিল। কেননা এই সালাত আদায় করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে। আরবি তারবিহা অর্থ বিশ্রাম। আর তারবিহা শব্দের বহুবচন তারাবিহ। সালাতুত তারাবিহ জামায়াতের সঙ্গে আদায়ের আয়োজন থাকায় অনেক মানুষ একই সঙ্গে কুরআন মাজিদ শুনতে শুনতে দীর্ঘ সময় ধরে নফল নামাজ আদায় করতে পারেন।

তেমনি সম্মিলিত আকারে আদায়ের কারণে রোজাদার মুসলমানদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে ঐক্য ও সমপ্রীতির দৃঢ় বন্ধন। এ জন্য হজরত ওমর রা. এর সময় থেকে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে রমজানুল মুবারকে সিয়াম সাধনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে তারাবিহ সালাতের জামাত। শহর এলাকার বেশির ভাগ মসজিদে খতম তারাবিহ হয়ে থাকে।

ফলে যারা নিয়মিত তারাবিহ নামাজে অংশ নেন, তাদের পক্ষে পুরো কুরআন মাজিদ একবার শোনার সুযোগ হয়। অতএব বিশেষ কোনো অসুবিধা না থাকলে রমজান মাসে সিয়াম পালনের পাশাপাশি সালাতুত তারাবিহে নিয়মিত যোগদানে সচেষ্ট থাকা উচিত। লেখক: বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। [কালেক্ট ফ্রম বাংলাদেশ প্রতিদিন]

তারাবি সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস সমূহ থেকে কিছু সহিহ হাদিস দলিল এখানে উপস্থাপন করা হল

১ নং দলিল: ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম (রহ.) এর উস্তাদ ইমাম আবু বকর ইবনে শায়বা (রহ.) বর্ণনা করেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবি এবং বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২/ ৩৯৪, হাদিস নং ৭৬৯০; সুনানে কুবরা ২/৪৯৮; মুজামে কাবির ১১/৩৯৬; আল-মুনতাখাব হাদিস নং ৬৫৩; মুজামে আওসাত ১/৪৪৪, হাদিস নং ৮০৭।)
২ নং দলিল : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার সুন্নতকে এবং সৎপথ প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধর। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৬০৭; সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং ২৬৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১৬৬৯২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪২; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৫; মেশকাত ১/২৯)

সহিহ সনদে প্রমাণিত যে, খুলাফায়ে রাশেদীন বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) বলেন- বিশ রাকাত তারাবি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের দ্বারা প্রমাণিত। (মাজামুউল ফাতাওয়া ২৩/১১৩)

৩ নং দলিল: রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের নিয়ে মাত্র তিন দিন জামাতের সাথে তারাবি আদায় করার পর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জামাতের সাথে তারাবি পড়া ছেড়ে দিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাকী জীবনে, আবু বকর (রা.) এর খিলাফতকালে এবং উমর (রা.) এর খিলাফতের প্রথম দিকে এ অবস্থাই বিদ্যমান ছিল। (সহিহ বুখারি ১/২৬৯, সহিহ মুসলিম ১/২৫৯; সুনানে আবু দাউদ ১/১৯৫)

রমজান মাসের কোন এক রাতে (১৪ হিজরীতে) হযরত উমর (রা.) মসজিদে নববিতে গেলেন এবং দেখতে পেলেন যে, মসজিদের বিভিন্নস্থানে ছোট ছোট জামাত হচ্ছে। তিনি ভাবলেন সকল নামাজিকে এক ইমামের পিছনে একত্র করে দেওয়া উচিত। তখন তিনি জামাতে তারাবি পড়ার নির্দেশ জারি করেন এবং হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) কে ইমাম বানিয়ে দেন। আর তিনি সাহাবিদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি পড়াতে লাগলেন। (সহিহ বুখারি হাদিস নং ২০১০; সুনানে আবু দাউদ হাদিস নং ১৩৭১; ইলাউস সুনান ৭/৬১)

৪ নং দলিল: ইমাম বায়হাকী (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘বিখ্যাত সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (রা.) বলেন, আমরা হযরত উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবি এবং বিতর পড়তাম।’

হাদিসটি সহিহ। সহিহ হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস, হাফেযুল হাদিস ইমাম নববি, ইমাম ওলিউদ্দীন ইরাকি, ইমাম তাকীউদ্দন সুবকি, ইমাম আইনি, ইমাম সুয়ূতি, ইমাম কাসতালানি, ইমাম যায়লায়ি প্রমুখ হাদিস বিশেষজ্ঞগণ। (উমদাতুল কারি শরহে সহিহ বুখারি ৭/১৭৮; ইরশাদুস সারি শরহে সহিহ বুখারি ৪/৫৭৮; মারেফাতুস সুনান ২/৩০৫; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ১/২৬৭; আল-মাজমু শরহুল মুহাযযাব ৩/৫২৭; তুহফাতুল আখইয়ার ১০৮)

৫ নং দলিল: হযরত উসমান (রা.) এর খিলাফতকালে বিশ রাকাত তারাবি পড়া হত। হযরত ইয়াযিদ ইবনে খুসাইফা রহ. থেকে বর্ণিত, প্রখ্যাত সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেন, হযরত উমর রা. এর যুগে তারা (সাহাবায়ে কেরাম) বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন এবং শতাধিক আয়াত বিশিষ্ট সূরা সমূহ পড়তেন। আর হযরত উসমান রা. এর যুগে দীর্ঘ দন্ডায়মান থাকার কারণে তারা লাঠিতে ভর দিতেন। হাদিসটি সহিহ। যেসকল হাদিস বিশেষজ্ঞগণ হাদিসটিকে সহিহ হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা হলেন- হাফেজুল হাদিস ইমাম নিমাভি, ইমাম নববি, ইমাম সুবকি, ইমাম যায়লায়ি, প্রমূখ মুহাদ্দিসগণ। (সুনানে কুবরা, বায়হাকি ২/৪৯৬; আসারুস সুনান ২/৪৭৩, হাদিস নং ৭৭৭; আত-তালীকুল হাসান ২/৫৪; নাসবুর রায়াহ ২/১৫১; ইলাউস সুনান ৭/৬৯) উল্লিখিত হাদিসটি স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রা. এর খিলাফতকালেও বিশ রাকাত তারাবি পড়া হত।

৬ নং দলিল: হযরত আলী (রা.) তার খেলাফতকালে বিশ রাকাত তারাবি পড়ার আদেশ দিয়েছেন। প্রখ্যাত তাবেয়ি আবু আব্দুর রহমান বলেন, ‘হযরত আলী (রা.) রমজান মাসে বিজ্ঞ কারীদেরকে ডাকলেন এবং তাদের একজনকে আদেশ দিলেন, যেন তিনি লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি পড়েন।’ হাদিসটি হাসান এবং সহিহ।

৭ নং দলিল: পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘যারা আনসার ও মুহাজির সাহাবিদের অনুসরণ করে আল্লাহতায়ালা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত’। (সুরা তাওবা, আয়াত- ১০০-১০১)
আর সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, আনসার ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন। (সুনানে আবু দাউদ ১/২০২; মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৩/১১২-১১৩; ইলাউস সুনান ৭/৬১)

৮ নং দলিল: ‘সকল সাহাবি জান্নাতি, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। তাদের আমল ও আদর্শের অনুসরণে আখেরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভ।’ (সুরা হাদীদ, আয়াত ১০; সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০২; সুনানে তিরমিযি, মেশকাত ২/৫৫৪; তাফসিরে মারেফুল কুরআন ১২৭৫ পৃ:)

মসজিদে নববিতে ১৪ হিজরিতে হযরত উমর (রা.) এর নির্দেশে বিখ্যাত সাহাবি উবাই ইবনে কা’ব (রা.) সাহাবিদেরকে নিয়ে জামাতে বিশ রাকাত তারাবি পড়া আরম্ভ করেন। আর এর উপর সাহাবিদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়। (আত-তামহীদ ৮/১০৮-১০৯)

এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও হাফেযুল হাদিস ইবনে আব্দুল বার (রহ.) বলেন, ‘হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) রমজান মাসে সাহাবিদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এতে কোন একজন সাহাবিও দ্বিমত পোষণ করেননি। (আল-ইস্তিযকার ৫/১৫৭; মাজমুউল ফাতাওয়া ২৩/১১২-১১৩; সুনানে তিরমিযী ১/১৬৬)

৯ নং দলিল: ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ইবনে আবী মুলাইকা আমাদের কে নিয়ে রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন।’ হাদিসটি সহিহ। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২/৩৯৩; আসারুস সুনান ২/২৫৩, হাদিস নং ৭৮৪; আওজাযুল মাসালেক ২/৩০৫)

১০ নং দলিল: হাফেজুল হাদিস ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) সহিহ সনদে বর্ণনা করেন যে, রমজানের প্রথম রাত যখন আগমন করত তখন ইমাম বুখারি র. এর নিকটে তার ছাত্র ও ভক্তবৃন্দরা একত্রিত হত। তিনি তাদেরকে নিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করতেন। প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত করে তেলাওয়াত করতেন। আর এভাবেই তিনি তারাবিতে কুরআন খতম করতেন। (মুকদ্দমায়ে ফাতহুল বারী শরহে সহিহ বুখারি ৫৬৫ পৃ: ১৫ নং লাইন)

তারাবির ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল ও আদর্শ ৮ রাকাত নয়, বিশ রাকাত। সুতরাং আখেরাতে যারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে চায় তাদের উচিত হল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল ও আদর্শের অনুসরণে ও অনুকরণে বিশ রাকাত তারাবি আদায় করা এবং নাজাত প্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। [কালেক্টেডঃ রিংসবিডি]

তারাবীর নামাজের ফজিলাত ও গুরুত্ব

তারাবির নামাজ এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর এবং বিতিরের পূর্বে আদায় করা হয়। তারাবির নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। যেটা গুরুত্বের দিক থেকে ওয়াজিবের কাছাকাছি।

তারাবির ফজিলত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকীর আশায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

রাসুল (সা:) তারাবিকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তারাবি যেন ফরজ না হয়ে যায়, যেটা আদায়ে উম্মতের কষ্ট হতে পারে, সেটা রাসুল (সা:) এর একটি হাদিসে থেকেই বোঝা যায়।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) একবার রমজান মাসে রাত্রিবেলায় মসজিদে নববীতে নামাজ (তারাবি) আদায় করলেন। উপস্থিত লোকজনও তার সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন। একইভাবে তারা দ্বিতীয় দিনেও নামাজ আদায় করলেন এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলো। অতঃপর তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো।

কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স.) হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের কাছে এলেন না। অতঃপর সকাল হলে তিনি এলেন এবং বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু শুধু এ ভয়ে আমি তোমাদের নিকট আসা থেকে বিরত থেকেছি যে, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, না জানি তোমাদের ওপর উহা (তারাবি) ফরজ করে দেওয়া হয়। (বুখারী)

তারাবি বিশ রাকাত সুন্নাত। এটা রাসুল (সা:), সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) রমজান মাসে বিশ রাকাত এবং বিতির পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা)

সমস্ত সাহাবীদের আমলও বিশ রাকাত ছিল। রাসুল (সা:) এর নাতি হযরত আলী ইবনে হাসান (রা:) থেকে বর্ণিত, হযরত ওমর (রা:) এর নির্দেশে লোকদেরকে নিয়ে উবাই বিন কাব (রা:) বিশ রাকাত তারাবি পড়েছেন। (আবু দাউদ)

এভাবে খলিফা ওমর, ওসমান, আলী (রা:) সহ সকল সাহাবীদের ঐক্যমতে বিশ তারাবি পড়া হয়েছে।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ:) বলেন, মক্কা ও মদীনা শরীফে সাহাবায়ে কেরামের যুগ হতে আজ পর্যন্ত সব সময় বিশ রাকাত তারাবি খতমে কোরআনসহ জামাতের সঙ্গে পড়া হয়। তারাবি নামাজে পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত বা শ্রবণ করা ও সুন্নত।

রাসূল (সা:)বলেন, যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে সে একটি নেকী অর্জন করবে এবং একটি নেকীকে দশগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে। (তিরমিজি)

কুরআনে কারীম তেলাওয়াতের মতো শুনলেও একই রকম সওয়াব। এজন্য তারাবি নামাজে পরিপূর্ণ আদবের সাথে মনোযোগ দিয়ে কোরআন শুনতে হবে।

বিশ রাকাত না পড়ে ইমামকে রেখে মসজিদ ত্যাগ করা উচিত নয়। রাসুল (সা:) বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে শেষ পর্যন্ত কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি আদায় করবে, তার জন্য পুরো রাত সিয়াম পালনের সওয়াব লাভ হবে। (তিরমিজি)

করোনায় সবকিছু থমকে গেছে। সংক্রমণ এড়াতে মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়সহ অনেক কিছুতে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তারাবির নামাজে সর্বোচ্চ ১২ জন অংশ নিতে পারবে বলে নির্দেশনা দেয় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যার কারণে মুসল্লিরা নিজ নিজ ঘরে এশা ও তারাবির নামাজ আদায় করছেন। সবাই ব্যক্তিগতভাবে তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহর রহমত ও বিপদ মুক্তির প্রার্থনা করছেন।

মাহে রমজানের বিশেষ ফজিলত পূর্ণ আমল তারাবির নামাজে কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত নয়। আসুন আমরা যথাযথ গুরুত্বের সাথে তারাবির নামাজ আদায় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন।

তারাবীর নামাজের নিয়ম

রমজানের সিয়ামের বিশেষ অনুষঙ্গ তারাবির সালাত। মুমিন বান্দারা যথাযথ গুরুত্ব ও ভাবগাম্ভীর্যতার সঙ্গে তারাবির সালাত আদায় করে থাকেন। দিনে রোজা রেখে রাতে দীর্ঘক্ষণ তারাবির নামাজের কষ্ট আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন।

পবিত্র রমজানের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতগুলোর অন্যতম এ সালাত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তার অতীতের গুনাহগুলো আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেবেন। (বুখারি শরিফ)।

মূলত মাহে রমজানে এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর বিতরের আগে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। সাধারণ নফল ও সুন্নতের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাবান, গুরুত্বের দিক থেকে তারাবির নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ, যা ওয়াজিবের কাছাকাছি।

তারাবি আরবি শব্দ, যা তারবিহাতুন শব্দের বহুবচন; যার অর্থ হলো আরাম, প্রশান্তি অর্জন, বিরতি দেওয়া, বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি। যেহেতু ২০ রাকাত তারাবির নামাজ প্রতি চার রাকাত অন্তর চার রাকাত নামাজের সমপরিমাণ সময় বিরতি দিয়ে আরামের সঙ্গে আদায় করা হয়, সেজন্য এ নামাজকে তারাবির নামাজ বলা হয়।

এ নামাজ আদায় না করলে অবশ্যই গুনাহগার হতে হবে। তারাবির নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। কারণ, মাহে রমজান যেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য মহিমান্বিত, তার মধ্যে অন্যতম হলো তারাবির নামাজ। রাসূলে কারিম (সা.) তারাবির সালাত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আদায় করতেন বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

আমাদের দেশে দুই ধরণের তারাবি প্রচলিত। একটি হলো সুরা তারাবি এবং অন্যটি হলো খতম তারাবি। সুরা তারাবি হলো পবিত্র কোরআনের যে কোন সুরা দিয়ে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা।

খতম তারাবি হলো রমজান মাসে সম্পূর্ণ কোরআন সহকারে তারাবি আদায় করা। উভয় পদ্বতিই ইসলাম অনুমোদন করে। তবে খতমে তারাবিতে সওয়াব বেশি। সুরা তারাবির মাধ্যমে নামাজ আদায় করলেও নামাজ আদায় হবে।

তারাবির নামাজ পড়ার নিয়ম: এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়। আর এ নামজকেই ‘তারাবির নামাজ’ বলা হয়।

তারাবি নামাজের নিয়ত: আরবি এবং বাংলা উভয়ভাবে নিয়ত করা যাবে। আরবি নিয়ত হচ্ছে, নাওয়াাইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা, রকাআতাই সালাতিত তারাবিহ, সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তাআলা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।

বাংলায় নিয়ত হচ্ছে, আমি কেবলামুখি হয়ে দুই রাকাআত তারাবির সুন্নতে মুয়াাক্কাদাহ নামাজের নিয়ত করছি। আল্লাহু আকবার। (জামাআত হলে যোগ করতে হবে এ ইমামের পেছনে পড়ছি)।

তারাবির নামাজ কিভাবে পড়বেন: দুই রাকাত নামাজ আদায় করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা। আবার দুই রাকাত নামাজ পড়া। এভাবে ৪ রাকাত আদায় করার পর একটু বিশ্রাম নেয়া।

বিশ্রামের সময় তাসবিহ তাহলিল পড়া, দোয়া-দরূদ ও জিকির আজকার করা। তারপর আবার দুই দুই রাকাত করে আলাদা আলাদা নিয়তে তারাবি আদায় করা।

জামাতে তারাবি: ফরজ নামাজ ব্যতিত অন্য সকল নামাজ একাকী আদায় করা উত্তম। কিন্তু তারাবি নামাজ ব্যতিক্রম। তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা শরীয়ত সম্মত। বরং তারাবি একাকী আদায় করার চেয়ে জামাতবদ্ধভাবে আদায় করা উত্তম।

কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তারাবির নামাজ জামাতে আদায় করেছেন এবং জামাতে আদায়ের ব্যাপারে তাকিদ দিয়েছেন।

পবিত্র রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়া নারী পুরুষের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *